ই-পেপার বাংলা কনভার্টার শনিবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার শনিবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




দুই যুগ ধরেই নিষিদ্ধ: তবুও থেমে নেই পলিথিন উৎপাদন
প্রতিদিন শুধু ঢাকায় ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ফেলা হয়
এসএম শামসুজ্জোহা
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৪, ১০:৩২ এএম আপডেট: ৩১.১০.২০২৪ ১১:০২ এএম  (ভিজিটর : ২০০)
আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর পলিথিন। প্রায় দুই যুগ আগে দেশে নিষিদ্ধ হয় পলিথিনের ব্যবহার। অথচ এই দীর্ঘ সময় ধরে নিষিদ্ধ পণ্যটির শক্ত অবস্থান হয়েছে ঘরে ঘরে সর্বত্র। পলিথিন বৈধ না অবৈধতা চট করে জানতে হলে যে কাউকেই দ্বিধায় পড়তে হয়। বহুল ব্যবহারের চাহিদায় ভর করে পণ্যটি এত সহজলভ্য হয়েছে যে, বিশাল বাজার ধরতে বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায়ী আর উৎপাদক চক্রও সমান তালে বেপরোয়া হয়েছে। এটি ঘিরে সারা দেশে অন্তত হাজারখানেক অবৈধ কারখানা গড়ে উঠেছে।

দেখা যায়, শহর-বন্দর-গ্রামে, হাটে-বাজারে, টিনের ঘর থেকে দালানে, হাতে হাতে শুধু পলিথিন আর পলিথিন। এ যেন পলিথিনের শহর, পলিথিনের দেশ। পরিবেশ, জনজীবন, জলাধার, ভূমি, নদী, সমুদ্র, প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এই পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও এর উৎপাদন, বিপণন এবং বিক্রি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। প্রশাসনের নাকের ডগায় পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্য দেদার বিক্রি, ব্যবহার এবং ফেলে দেওয়া হলেও কারোরই যেন কিছু করার নেই। অপচনশীল পলিথিনের বিকল্প পণ্য বাজারে থাকলেও সেগুলো ব্যবহার সামান্য। এসব বিকল্প পণ্য ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগও নেই। তাই সহজলভ্য পলিথিনের যথেচ্ছ এবং নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে সারা দেশ পলিথিন এবং নিম্নমানের প্লাস্টিকে সয়লাব। পলিথিনে ভরে গেছে দেশের নদী-সাগরের তলদেশ। সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর তলিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই পলিথিন এবং প্লাস্টিক বোতল। ভেঙে পড়ছে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।

পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা দীপঙ্কর বর বলেন, পলিথিন আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সম্প্রতি পলিথিন ব্যবহার ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অনেকেই বন্ধ না রেখে গোপনে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। আগামীকাল ১ নভেম্বর থেকে কোথাও কেউ পলিথিন ব্যবহার ও উৎপাদন করতে পারবে না। উৎপাদন করলে তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে যে শাস্তির বিধান আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ১ নভেম্বর থেকে দেশব্যাপী পরিচালিত পলিথিন বন্ধে অভিযানের মনিটরিং করবে। মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রয়োজনে মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শন করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি-দুটি নয়, নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন কারখানা গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। দেবীদাস ঘাট, চকবাজার ইসলামী উচ্চ বিদ্যালয়ের আশপাশ, চকবাজার বড় কাটরা, আরমানীটোলা, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীর চরসহ বিভিন্ন স্পটে দিনরাত চলে পলিথিন তৈরির কাজ। এসব এলাকায় পলিথিন তৈরির সরঞ্জাম বিক্রির জন্যও রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং, রোল ম্যানুফ্যাকচারার্স ওনার্স অ্যান্ড ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় দেড় শতাধিক দোকান থাকলেও চকবাজারের পেয়ারা মার্কেট, লুতফর নাহার ম্যানশন, আবুল হোসেন মার্কেট, মৌলভীবাজার মাংসপট্টি মসজিদ গলি, সালাম মার্কেট, মাওলানা মার্কেট, শামসুদ্দিন প্লাজা ও এসরার ম্যানশনে তিন শতাধিক পাইকারি দোকানে প্রকাশ্যে বেচাকেনা চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্যাকেজিং, রোল ম্যানুফ্যাকচারার্স ওনার্স অ্যান্ড ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু মোতালেব বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটি কখনো সম্ভব নয়। পর পর দুই সরকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এটি করতে চেয়েছে। কোনো সরকার এটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। টাস্কফোর্স নামিয়েও এটি সম্ভব হয়নি। এছাড়া গত ২০ থেকে ২২ বছরে তারা কোনো বিকল্প ব্যবস্থাও করতে পারেনি। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি পরিবারে চারটি করে ধরলেও ঢাকায় প্রতিদিন এক কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। সরকারি নজরদারি সংস্থাগুলো নির্বিকার থাকায় বিক্রেতারা দেদার বিক্রি করছেন, ক্রেতারা কিনছে। এভাবে পণ্যটির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে সবার। 

সরকার যখন ২০০২ সালে তা নিষিদ্ধ করে, তখন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়। বাজারজাত করলে শাস্তি ছয় মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। নিষিদ্ধের ঘোষণা এবং আইনের বিধান রাখা হলেও ২২ বছরেও বাজার থেকে পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এমন এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি এক সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ১লা অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এমন ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে পলিথিন বাজারে বিক্রি করতে পারবেন কি না এই সংশয় তৈরি হয়েছে। 

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, প্রতি পরিবারে চারটি করে ধরলেও ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগের চান্দিরঘাট পুরো এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় অননুমোদিত প্লাস্টিক উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে ৯ শতাধিক অবৈধ পলিথিনের উৎপাদন কারখানা রয়েছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরে। ফলে শহরসংলগ্ন নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে বেশি। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বরিশালের কীর্তনখোলা, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরুস্তর পড়েছে। এসব নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের আস্তরণ জমার কারণে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিনের প্রভাবে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে ও নদীভাঙন বাড়ছে। নদীতে মাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বহু প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। 

শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র জলাবদ্ধতা মারাত্মক সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। শহর, গ্রামের পয়ঃনিষ্কাশনে ব্যবহৃত ড্রেন ময়লায় বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ময়লার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। তবু নাগরিক সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ ইকবাল মো. শামীম বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ এককভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান করবে আর নাগরিকরা পলিথিন ব্যবহার করতেই থাকবে। এ ধারণা ঠিক নয়। সব অংশীজনকে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে যা সফল বাস্তবায়নে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার কমে আসবে। যারা পলিথিন ও প্লাস্টিক উৎপাদন করে তাদের বিকল্প পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত করার জন্য কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তর ডিজিটাল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান তিনি। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মহাসচিব শরীফ জামিল বলেন, পুরো পৃথিবী থেকে পলিথিন ও প্লাস্টিক বাতিল করা হচ্ছে বা করছে। বিশ্বের প্রথম ১০টি পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সমুদ্রের তলদেশ পলিথিন-প্লাস্টিকে ভরে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছর পর সমুদ্রে মাছের চেয়ে পলিথিন বেশি থাকবে। একটি পলিথিন মাটিতে পুঁতে রাখলেও নষ্ট হতে সময় লাগে প্রায় ৪শ বছর। এক কথায় পলিথিন ও প্লাস্টিক আমাদের সামগ্রিক জীবন খেয়ে ফেলছে। তিনি আরও বলেন, সরকার পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন, বহন, পরিবহণ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বিকল্প কী ব্যবহার করতে হবে তার গাইডলাইন দেয়নি। ফলে আইন কাগজে-কলমে। সব অংশীজনকে নিয়ে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।





আরও খবর


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]