ফলিক এডিসের (ফোলেট) ঘাটতির কারণে স্পাইনা বিফিডা, হাইড্রোসেফালাস এবং অন্যান্য নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (এনটিডি) আক্রান্ত শিশু জন্মের ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এনিটিডি’র মতো জন্মগত ত্রুটি নিয়ে দেশে কতজন শিশু জন্ম নিচ্ছে এ বিষয়ে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই। তাই সচেতনা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানো এবং একটি জরিপ পরিচালনার তাগিদ গিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্পাইনা বিফিডা ও হাইড্রোসেফালাস দিবস ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক মত বিনিময় সভায় এ কথা জানানো হয়। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন) এর কারিগরি সহযোগিতায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজন করে। প্রতি বছর ২৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিশ্ব স্পাইনা বিফিডা ও হাইড্রোসেফালাস দিবস পালিত হয়।
৭৬ তম ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলির (ডব্লিউএইচএ) তথ্য উল্লেখ করে সভায় জানানো হয়, প্রজনন বয়সসীমার নারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশেরও বেশি নারী ফোলেটের অপ্রতুলতায় ভোগে। জন্মগত ত্রুটির কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে আনুমানিক ২ লাখ ৪০ হাজার নবজাতক মারা যায়। একটি বড় জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া ১০টি শিশুর মধ্যে ৯টিই জন্ম নেয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে। বাংলাদেশে ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে ২০১১-১২ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফোলেটের ঘাটতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশ যা ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে ২০১৯-২০ এর পরিসংখ্যানে ২৯ শতাংশে উপনীত হয়েছে। এই সার্ভেতে দেখা যায় যে, প্রতি ৭ জন নন-প্রেগনেন্ট নন-ল্যাকটেটিং নারীর মধ্যে ২ জনই ফোলেট ঘাটতিতে ভুগছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য অনুবিভাগ) কানিজ মওলার সভাপতিত্বে সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুদীপ্ত কুমার মুখার্জী। অন্যানের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (জনস্বাস্থ্য অধিশাখা) ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী, যুগ্ম-সচিব (মানব সম্পদ ও জনস্বাস্থ্য ২) আনোয়ার হোসেন আকন্দ, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জয়নুল ইসলাম, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুণর্বাসন কেন্দ্রের পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সারোয়ার ইবনে সালাম, গেইনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. রুদাবা খন্দকারসহ আরও অনেকে।
স্পাইনা বিফিডা, হাইড্রোসেফালাস ও নিউরাল টিউব ত্রুটিসহ জন্মগত ত্রুটি এবং তা প্রতিরোধে করনীয় বিষয়ে আলোকপাত করে মূল উপস্থাপনায় বলা হয়, এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হলো খাদ্যে ফোলেট ঘাটতি। এই ঘাটতির কারণে গর্ভকালীন সময়ে ভ্রূণ থেকেই সমস্যার সূত্রপাত হয়, ফলত মৃতশিশু জন্ম বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশুর জন্ম হয় এবং বেঁচে থাকলে সারাজীবন তাদের নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা জর্জরিত অত্যন্ত বিপন্ন অবস্থায় কাটাতে হয়।
বক্তারা বলেন, খাদ্যে অনুপুষ্টির ঘাটতি নীরব ঘাতক হিসেবে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। ৭৬তম ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলিতে ‘নিরাপদ এবং কার্যকর খাদ্য সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি প্রতিরোধ এবং ঘাটতিজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- স্পাইনা বিফিডা এবং অন্যান্য নিউরাল টিউব ত্রুটি নিরসন’ বিষয়ে গৃহীত রেজোলিউশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা দরকার।
বাংলাদেশে লবণে আয়োডিন এবং ভোজ্য তেলে ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশনের সাফল্যে কথা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইরান ইত্যাদিসহ বিশ্বের ৮৬টি দেশে ফোলেট ঘাটতি নিরসনে আটা-ময়দায় ফোলেট ফর্টিফিকেশন করা হয়েছে এবং বেশ সফলভাবেই ফোলেট ঘাটতিজনিত স্বাস্থ্য সংকট কাটিয়ে উঠেছে। এইসব সফল কার্যক্রমসমূহের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশেও এই স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ারা তাগিদ দেন তারা।
উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গত প্রায় ৪০ বছর ধরে অপুষ্টিজনিত ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ফুড ফর্টিফিকেশন বা খাদ্য সমৃদ্ধকরণ পদ্ধতি চালু আছে। বিশ্বের ৫৩টি দেশে আটা-ময়দায় ফলিক এসিড সমৃদ্ধকরণ করা হচ্ছে। এবং কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কোস্টারিকা, চিলি, আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলে খাদ্যে ফলিক এসিড সমৃদ্ধকরণ উদ্যোগের কারণে এনটিডি কমেছে।