প্রকাশ: বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪, ১১:০১ এএম (ভিজিটর : ২০৭)
উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। আর এই ঘাতক কতটা নির্মম হতে পারে; তা দেশের মানুষ দেখেছে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে। তাতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই দেশে মূল্যস্ফীতি কমেনি। অথচ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়। এটা ঠিক যে অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রেই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি হাতে পেয়েছে। বাজার পরিস্থিতি নানা চেষ্টাতেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কখনও দায় চাপানো হচ্ছে সিন্ডিকেট-এর ওপর, কখনও বা বৈরী প্রকৃতিকে দাঁড় করানো হচ্ছে কাঠগড়ায়। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। দ্রব্যমূল্যের আগুনে পুড়ছে সব শ্রেণির মানুষ। চাল, ডাল, ডিম, সবজি থেকে শুরু করে সব পণ্যের দামই এখন লাগামছাড়া। এতদিন সবজি দিয়ে মাছ-মাংসের ঘাটতি কিছুটা পূরণের চেষ্টা করা গেলেও বেশ কিছুদিন থেকে সবজির দিকে হাত বাড়ানো দুঃসাহসিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, দেশে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সরবরাহব্যবস্থাকে আরও সুগঠিত ও জোরদার করতে যাচ্ছে সদ্য দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার। পরিকল্পনার আওতায় গত জুলাই মাসে ভেঙে পড়া সরবরাহব্যবস্থাকে দ্রুত স্বাভাবিক ও সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন পণ্য ও সেবার সরবরাহব্যবস্থাকেও একটি টেকসই কাঠামোয় রূপ দেওয়া হবে। যা মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চার পদক্ষেপ বাস্তবায়নে তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে এগুলো বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসহযোগিতা। সুযোগ বুঝে অসাধু ব্যবসায়ীদের বেশি মুনাফার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এসব কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। এসব সমস্যা বিগত সরকারের তৈরি। কিন্তু সেগুলো এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকার প্রবাহ হ্রাস, শুল্ক কমানো, সুদের হার বৃদ্ধি এবং বাজার তদারকি জোরদারের মতো চার ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে সিন্ডিকেট করছে তাদের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করার ঘোষণা দিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করছে?- এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, একের পর এক অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করছি। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। বন্যায় অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে, যে কারণে শাক-সবজির দাম বেশি কিন্তু অন্য পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে এখানে সিন্ডিকেটের একটা বড় প্রভাব আছে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য আমরা কাজ করছি। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনকে দুর্বল করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত আগস্ট মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৬৮ শতাংশের ঘরে। জুন মাসে এই হার ছিল ৯.১৫%। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪.১০% হয়েছে। যা আগের জুন মাসে ছিল ১০.৪২%। যদিও সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতি কমার কোনো প্রভাব জীবনযাত্রায় খুঁজে পাচ্ছে না। বরং প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। অথচ নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল। এবার অন্তত মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে তারা মুক্তি পাবে। এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। একটু সময় লাগবে।’ এ জন্য তিনি অধৈর্য না হতে বলেছেন। তবে বাজারের যে পরিস্থিতি, তাতে মানুষের পক্ষে ধৈর্য ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের গৃহীত নীতির প্রতি মানুষের আস্থা থাকতে হবে। সরকার যে আসলেই মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে; এই বিশ্বাসটা আনতে হবে। এমন নয় যে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন পণ্যের শুল্কহার কমানো হয়েছে। নীতি সুদহার বেড়েছে। তবে এখনো এর তেমন কোনো প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারকে এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। এজন্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পথ অবারিত রাখতে হবে। উৎপাদন খাতে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় সব ধরনের বাধা অপসারণ করতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী সন্দেহভাজন বা পলাতক তাদের বিশেষ তদারকির আওতায় আনতে হবে। যাতে বাজারে পণ্যে মূল্য বাড়াতে তারা কারসাজি করতে না পারে। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হবে। তারা আরও বলেছেন, সরকার পণ্যমূল্য কমাতে আমদানি শুল্ক কমাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব নয়। অতীতে এ ধরনের পদক্ষেপ বাজারে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। শুল্ক কমানোর সুফল পেতে হলে প্রয়োজন যথাযথভাবে বাজার তদারকি। এ কারণে সরকার বাজার মনিটরিং জোরদারের নির্দেশ দিয়েছে। তারা বলেন এখনই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ যেভাবে পণ্যমূল্য বাড়ছে তাতে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে। সরকার এখনই সতর্ক না হলে মার্চে শুরু হওয়া রমজানে বাজার পরিস্থিতি ভোক্তার জন্য পীড়াদায়ক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বড় একটি কারণ ছিল অর্থনৈতিক মন্দা। ছাত্ররা পড়াশোনা শেষ করে অর্থনৈতিক মন্দায় কর্মসংস্থান করতে পারছিল না। জনগণ পণ্যমূল্য বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করতে পারছিল না। এই দুই কারণে আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। নতুন সরকারকে এখন বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এতে উৎপাদনও বেড়ে একদিকে পণ্যের জোগান বাড়বে, ফলে দাম কমবে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়ায় মানুষের আয় বাড়বে; তখন মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা হলেও তাদের ওপর কম পড়বে।
তিনি বলেন, বাজারে তথ্যের ঘাটতিও প্রকট। দেশের জনসংখ্যা কত হবে। বিদায়ী সরকার ১৭ কোটি ধরে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের হিসাব করত। বাস্তবে জনসংখ্যা আরও বেশি বলে অনেকে মনে করেন। বিশ্ব জরিপ সংস্থা নামে একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যা এত বেশি হবে বলে অনেকে মনে করেন না। কিন্তু বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় করতে হলে প্রকৃত জনসংখ্যার তথ্য থাকতে হবে। সেটি এখন কারও কাছেই নেই। এজন্য সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশে জনসংখ্যার প্রকৃত চিত্র বের করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের জরিপ জরুরি। সরকারের কেন্দ্রীয়সহ স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা এখনও ঠিকভাবে কাজ করছে না। এতে তদারকি ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়েছে। যে কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার তথ্যের ঘাটতিতে সঠিক পদক্ষেপও নেওয়া যাচ্ছে না। তাই সরকার এখন পণ্যের দাম কমাতে শুল্ক কমাচ্ছে।