নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সবজিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম রাতারাতি কমে আসে। কিন্তু তা ছিল খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। কদিন পরই আগের চিত্রে ফিরে আসে বাজার। দেশে চালের উৎপাদন ভালো হওয়া সত্ত্বেও বাড়ছে চালের দাম। কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই; তারপরও দাম বাড়ছে ডিমের। কারসাজির বাজারে এখন সবচেয়ে আলোচিত পণ্য ডিম। ফার্মের মুরগির ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা হালি। বন্যার অজুহাতে ডিমের মতো চালের দামও অত্যধিক হারে বেড়ে যায়, যা আর কমেনি। ৬২ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হওয়া সরু চাল এখন ৭২ থেকে ৭৪ টাকা। মধ্যবিত্তের চাল হিসেবে পরিচিত মাঝারি আটাশ চালের দাম ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে এবং গরিবের মোটা চাল ৫৫ টাকায় গিয়ে উঠেছে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক ও বাজারে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন পণ্যে অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রগুলো ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরনো চক্রগুলো বাজারে গেঁড়ে বসেছে। চাহিদা-জোগানের সূত্র কিংবা ক্রয়মূল্যের ওপর ভিত্তি করে দাম কমছে-বাড়ছে না। অসাধুরা আগের কায়দায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এর চড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে ভোক্তাকে; সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন দিন দিন হয়ে পড়ছে দুর্বিষহ।সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে নতুন সরকার। অন্তর্বর্তী এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাজার নিয়ন্ত্রণে বেশ জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত দেয়। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। শুধু হাত বদল হয়েছে। পরিসংখ্যান বিবেচনায়, বছরের ব্যবধানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে বাজারে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। কম মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মানুষ এখন বাজারে গিয়ে হাঁসফাঁস করছেন। বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ। নিত্যপণ্য থেকে শাকসবজির দাম ৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
জানা যায়, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজির বিষয়টি অনেকটা ওপেন-সিক্রেট। সিন্ডিকেট বলতে যাদের বোঝানো হয়- তারা একদিকে যেমন বড় আমদানিকারক; আবার নানাভাবে ব্যাংকগুলোর মালিকানা বা ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্বেও আছেন তারাই। কারসাজি করে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর নেপথ্যে আছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে যদি কোনো পণ্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ; ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে সে পণ্যের দাম বাড়ে ৮০-৯০ শতাংশ। প্রতিটি পণ্যেই রয়েছে বাজার সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট ইচ্ছোমতো দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট ফাঁকা করছে; অথচ কোনো প্রতিকার মিলছে না। এ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
ভোক্তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। জীবনযাত্রার খরচ যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। ফলে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন। বাজারে গিয়ে মানুষ ক্ষোভ ঝাড়ছেন সরকারের বিরুদ্ধে। দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেট করে একটি চক্র পণ্যের দাম বাড়িয়ে প্রতিবছর ভোক্তাকে জিম্মি করে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করলেও সরকার কার্যত অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। ফলে বাজার সিন্ডিকেটের দাপুটে উত্থান ঘটছে নির্বিঘ্নে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে উৎপাদন-পরিবহণসহ কয়েকটি খাতের খরচ মিলিয়ে পাইকারি পর্যায়ে একটি ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হওয়ার কথা ১১ টাকা ৩২ পয়সা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা দামে। এর মানে, প্রতি ডিমে অযৌক্তিকভাবে ভোক্তার কাছ থেকে ৩ টাকা ৬৮ পয়সা আদায় করা হচ্ছে। বাড়তি এ টাকা খামারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতারা হাতিয়ে নিচ্ছে। চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও কেন প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে; তা নিয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারের কোনো কিছুই বদলায়নি। চাঁদাবাজি চলছে পণ্যের দামও অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে সরবরাহকারীরা। বন্যার প্রভাবে ডিমের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে; তা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন তারা। বন্যার অজুহাতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে এর সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট মাত্র ২০ দিনে ২৮০ কোটি টাকা লুট করে নিয়েছে- এমন অভিযোগ করছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। সংগঠনটির সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, এ খাতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতোই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ী সমিতিগুলোও আড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে এক পিস ডিমের দাম ১২ থেকে সাড়ে ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয় বলেন তিনি। শুধু ডিম কিংবা মুরগি নয়। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যে গেঁড়ে বসে আছে পুরনো সিন্ডিকেট। অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রগুলো যে কোনো অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিতে মরিয়া। আর বাজারে জিম্মি হয়ে আছেন ভোক্তারা।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনরা বলছেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার বিকল্প নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাদের, তারা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তাদের পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত। তারা বলছেন, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ৫ থেকে ৬টি করপোরেট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজারে কিছুই বদলাচ্ছে না। হয়তো খেলোয়াড় বদলাচ্ছে। আমাদের বাজারে দেখতে পাই, নতুনরা কিংবা ছোটরা ব্যবসায় পেরে উঠছেন না। হাতেগোনা কয়েকটি বড় খেলোয়াড়ই খেলছেন। তাদের হাতেই বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এটা হলে এমন পরিস্থিতিই সৃষ্টি হবে। বাজারে এসব বড় খেলোয়াড়ের প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুনরা যাতে প্রতিযোগিতা করতে পারে, তেমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব ত্রুটি রয়েছে; সেসব দূর করতে হবে।
ড. জাহিদ আরও বলেন, পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির আরেক কারণ চাঁদাবাজি। আমরা দেখলাম, অন্তর্বর্তী সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে এটা বন্ধ হয়ে গেল। সবজিসহ আরও অনেক পণ্যের দাম কমে এলো। অথচ সেটা ধরে রাখতে পারলাম না। সেখানেও খেলা একই, শুধু খেলোয়াড়ের বদল হলো। চাঁদাবাজি বন্ধের যে সুুযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটা ধরে রাখতে না পারাটা বর্তমান সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা।