বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আগামীকাল মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে সাড়ম্বরে উৎসব শুরুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। এবার সারাদেশে ৩২ হাজার ৬৬৬ টি পূজা মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। পূজার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব পুলিশ ও আনসার বাহিনীর পাশাপাশি মাঠে সক্রিয় রয়েছে সেনা নৌ বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, এবার আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব পালনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। পূজা মণ্ডপ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সারাদেশের স্থানীয় প্রশাসনকে আট দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া এবারের পুজোয় সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে পূজা আয়োজন করার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ভোরের ডাককে বলেছেন, প্রতি বছরের মত এবারও সারাদেশে উৎসবের মধ্য দিয়ে দুর্গা পূজা আয়োজনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা চাই অত্যন্ত সুন্দর,নিরাপদ ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, নিরাপদে নির্বিঘ্নে আমরা পূজা করতে পারব। পূজার সার্বিক বিষয় নিয়ে আমরা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশবাহিনী সহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সভা করেছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করে আমাদেরকে সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আমরা আশা করছি সেনাবাহিনী সহ সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় এবার শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা সম্পন্ন করতে পারব।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ প্রমানিক ভোরের ডাককে বলেছেন, আমরা আশা করছি এবার সবচেয়ে সাড়ম্বরে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হবে। প্রশাসনের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, তারা দুর্গাপূজার সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও দুর্গাপূজার নিরাপত্তায় নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গঠন করার খবর আমরা পেয়েছি। এজন্য আমি হিন্দু মহাজোটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পক্ষ ৮ দফা দফা বাস্তবায়নের জন্য রাজপথে মিছিল সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। শারদীয় দূর্গা পূজার পর প্রথম শনিবার চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে মহা সমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু জোট। এমন প্রেক্ষাপটে এবারের পুজোয় যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সক্রিয় অবস্থান রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, দুর্গাপূজায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে একটি অশুভ চক্র বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য অপ তৎপরতায় লিপ্ত আছে।
সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাঠে সক্রিয়ভাবে কঠোর অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকরমিরা। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল -বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্য জোট সহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে সারাদেশের মন্দির ভিত্তিক নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করেছে বলে জানা গেছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি'র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্ট এর সহ-সভাপতি রমেশ দত্ত ভোরের ডাককে জানিয়েছেন, আমাদের নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি'র পক্ষ থেকে সারা বাংলাদেশে মন্দির ভিত্তিক নিরাপত্তা টিম গঠন করা হয়েছে। দেশের ৩২ হাজার পূজা মন্ডপে বিএনপি নেতাকর্মীরা অতন্ত্র প্রহরী হয়ে মন্দির পাহারা দিবে। যাতে করে আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা মন্দিরে - মন্ডপে হামলা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে।
জানা গেছে, হিন্দু শাস্ত্র মতে কৈলাশ থেকে মর্ত্যলোকে আসবেন দেবী দুর্গা। এই উৎসব ঘিরে, সারাদেশের মন্ডপে-মন্ডপে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। প্রতিমা তৈরিতে মাটির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন রং-তুলির আঁচড় শেষে প্রতিমা মন্ডপে নেওয়ার অপেক্ষায় সবাই। তাই ব্যস্ততায় দিন-রাত এক করে ফেলছেন প্রতিমাশিল্পীরা। দম ফেলার সময় নেই প্রতিমা শিল্পী ও আয়োজকদের।
এদিকে পূজায় মন্দিরে আগত দর্শনার্থীদের নজর কাড়তে, সাজসজ্জায় নানা উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন মন্দিরে এখন চলছে থিমভিত্তিক সাজসজ্জার কাজ।
আগামী ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গোৎসব। এরপর মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমীতে (১৩ অক্টোবর) বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী এই উৎসবের শেষ হবে। এ বছর দেবী দুর্গা মর্তে আগমন করবেন দোলায় আর ঘোড়ায় চড়েই তিনি ফিরে যাবেন স্বর্গলোকে। সরকারি হিসেবে সারাদেশে বরাবরের মতোই পূজার জোর প্রস্তুতি চলছে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রমনা কালি মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, লালবাগ ঋষিপাড়া মন্দির, রাজারবাগ কালিমন্দির, শাঁখারি বাজার মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরসহ সারাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে।
গত ২ অক্টোবর মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এ বছরের শারদ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবী পক্ষের শুরুর তিথি এই মহালয়া।
হিন্দু শাস্ত্রমতে, মহালয়া তিথিতে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে (পৃথিবীতে) আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ দিন ভোরে চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়েই মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গাকে এ আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।
আগামী ৯ অক্টোবর সকাল ৮টা ৪৪ সেকেন্ডের মধ্যে মহাষষ্ঠী কল্পনারম্ভ শেষ করতে হবে। শায়ণকালে দেবীর অধিবাস ও আমন্ত্রণ। ১০ অক্টোবর সকাল ৭টা ৫৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের মধ্যে দেবীর মহাসপ্তমী পূজা শেষ করতে হবে। ১১ অক্টোবর সকাল ৬ টা ৫২ মিনিটের মধ্যে মহাষ্টমী পূজা ও ৬ টা ৫২ মিনিটে আরম্ভ এরপরেই কুমারী পূজা। পরে ৭ টা ৪১ মিনিটের মধ্যে সন্ধী পূজা শেষ করতে হবে। ওইদিনই সকাল ৭টা ৪১ মিনিট পর মহানবমী আরম্ভ ও ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে মহানবমীর বিহিত পূজা শেষ করতে হবে। ১২ অক্টোবর ৬টা ১২ মিনিটের মধ্যে মহানবমীর বিহিত অধিক পূজা শেষ করতে হবে।
উল্লেখ্য এবার প্রতিটি মন্দিরে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫০০ কেজি করে জিআর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।একই সঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও মন্দিরে মন্দিরে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপি জামাত সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মন্দিরে মন্দিরে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের খবর পাওয়া গেছে।