ই-পেপার বাংলা কনভার্টার শনিবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার শনিবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৫
Select Year: 
ব্রেকিং নিউজ:




কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য সংস্কার ও জনস্বস্তি জরুরি
ইয়াহিয়া নয়ন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪, ৪:৫৫ পিএম আপডেট: ০৩.১০.২০২৪ ৫:১৫ পিএম  (ভিজিটর : ৬০৯)
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক লেখালিখি হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিক্রেতারা বলেন, সরবরাহ নেই, তাই দাম বেড়েছে। ভোক্তা অধিকারের অফিস বলে, যথেষ্ঠ সরবরাহ আছে।  বিশ্লেষকরা বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছেনা। তবে সরকার পক্ষ সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করে। বিগত সরকারের সময়ে নিত্যপণ্যের দুর্মূল্যের জন্য সাধারণ মানুষ এই সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে। এই সিন্ডিকেট যে সরকারি দলের লোকজন মানুষ তাও বলেছে।

বিগত সরকার পতনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা গেল, রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ এবং ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে পড়ায় জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু তিনমাস পরেও বাজার পরিস্থিতি আগের জায়গাতেই রয়েছে। বর্তমানে চাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের মতো অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির খুচরা মূল্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। রাজনৈতিক দলের সরকারকে দলীয় নেতাকর্মীদের স্বার্থ দেখতে হয়। তাই তারা চাইলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের তো সেই  দায় নেই। তাহলে অসাধু ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজদের প্রতি কঠোর হতে সমস্যা কোথায়? 

নতুন সরকার গঠনের প্রাক্কালে সাধারণ শিক্ষার্থী-জনতা ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের ওই-সংক্রান্ত কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না; বিনিময়ে কোনো সুবিধাও ছিল না। তখন লক্করঝক্কর গাড়ি রাস্তায় বের হতোনা, ভয়ে। তার পরও তারা প্রশংসার কাজ করেছে। পরবর্তী সময়ে ট্রাফিক পুলিশের কাজে ফেরার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আর রাস্তায় না নামতে অনুরোধ করা হয়। 

কিন্তু গত তিন মাসে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। দায়িত্ব পালনকারীদের দায়সারা আচরণে মাঝেমধ্যেই যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এমনটা চলতে থাকলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার প্রবণতা বাড়বে। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হবে। সরকারের ব্যর্থতাগুলো খালি চোখেই প্রকটভাবে ধরা পড়বে। 

দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ সেক্টরে ৫০ লাখের বেশি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। তাছাড়া এ খাতের অধিকাংশ লেনদেন হয় বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তারা নির্ধারিত সময়সীমার ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস। এমন একটি স্পর্শকাতর খাতে মাসাধিককাল অস্থিরতা চলছে। অথচ সরকার এ সমস্যা সমূলে উৎপাটন করতে পারছে না। গুটিকতক প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক নেতা নাকি এ সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছেন। সাধারণ শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে। তাহলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে কেন এটার সমাধান করা যাচ্ছে না? শিল্প সেক্টর নিয়ে গুজব আর উস্কানিতে ইন্ধন দিচ্ছে কারা? কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা?  বিদেশী ক্রেতারা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে গত চার দশকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমাদের বিশাল মার্কেট (বিশ্ববাজারের প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ) হাতছাড়া হবে। বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কর্ম হারাবেন। আর্থসামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। তাই এ বিষয়ে উদাসীন বা কম মনোযোগী হওয়ার সুযোগ নেই। 

এর আগে কেয়ারটেকার সরকারের সময় দুর্নীতিবাজরা ভয়ে তটস্থ থাকত। ক্ষমতাসীন থাকাকালীন অপকর্মের জন্য আইনের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে তারা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেড়াত। সাধারণ মানুষ সাময়িক স্বস্তি পেত। অসৎ লোকদের চক্রান্ত কিছুদিনের জন্য হলেও হ্রাস পেত। এতে সাধারণ মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। অথচ এখনো দুর্নীতিবাজ আমলারা সচিবালয়ে বসে অন্যায় বাণিজ্য করে চলেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার আগের কেয়ারটেকার সরকারগুলোর চেয়ে শক্তিশালী বলেই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় তিন মাস হতে চললেও বিস্ময়করভাবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। 

তদুপরি সরকারের অগ্রাধিকার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আপাত নিষ্ক্রিয়তা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া প্রভৃতি কারণে দেশের নানা প্রান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিক হাজির হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করলেও তাদের কঠোর হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দুষ্টু লোকেরা নানাভাবে সমস্যা সৃষ্টি করতে সদা সচেষ্ট থাকছে। কোনো একটি ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি যা অপচেষ্টাকারীদের কঠোর বার্তা দেবে। এখনও পিটিয়ে হত্যা বাড়ছে। সাধারণ মানুষের আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটা কঠোর হস্তে দমন করা দরকার। 

সম্প্রতি দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা সবার নজর কেড়েছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতরা দলবেঁধে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার উৎসবে মেতে উঠছে, বিষয়টা ভয়ংকর। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভিসি, প্রক্টর ও সংশ্লিষ্ট হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ছিলেন। তারা কেন ওই দীর্ঘ (পিটিয়ে মারার) প্রক্রিয়ায় কোনো তথ্য পেলেন না, দ্রুত সেখানে পৌঁছতে ব্যর্থ হলেন? তবে কি সেখানে অতীতের ক্ষমতাসীনদের মতো বিশেষ কোনো গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে যাদের অপকর্ম প্রশাসন জানার পরও উপেক্ষা করেছে? 

সম্প্রতি আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল অস্থির হয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন থেকেই সেখানে বিভিন্ন গ্রুপ অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমাদের সেনাবাহিনীর নিরলস চেষ্টায় তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় তারা সুযোগ নেবে সেটা স্বাভাবিক। তাছাড়া সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী ব্যস্ত থাকায় তাদের সক্রিয় হয়ে ওঠা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের নিবৃত্ত করতে হবে। নইলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়। 

মিডিয়া বিস্তারের এ যুগেও কিছু উপদেষ্টার উপস্থিতি একদম টের পাওয়া যাচ্ছে না। নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন নানা সংকটেও তাদের ভূমিকা সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করছে। মাঝেমধ্যে তাদের সিদ্ধান্তগুলো ঠিক কারা নিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। স্বল্পমেয়াদের সরকারের জন্য তিন মাস মোটেও কম সময় নয়। 

সরকারের উপদেষ্টাদের অধিকাংশই কর্মজীবনে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন বর্তমান পদে ভালো পারফর্ম করার জন্য নেতৃত্বের গুণাবলি অপরিহার্য। সেটার ঘাটতির কারণেই সম্ভবত জনগণের ভোগান্তির বিষয়গুলো তাদের স্পর্শ করছে না। জনপ্রত্যাশার পুরো চাপ ধীরে ধীরে এককভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর ভর করছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। 

 অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। এ সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের ডুবন্ত অর্থনীতিকে রক্ষা করা। এমনকি নবনিযুক্ত গভর্নর শুরুতে চরম হতাশাজনক তথ্য শেয়ার করেছিলেন। কিন্তু আমার মতে, এ খাতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাদের পদক্ষেপগুলো কাজ করতে শুরু করেছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল হয়েছে, প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলার পাওয়া যাচ্ছে, বিলাসদ্রব্য ছাড়া সব পণ্যের এলসি মার্জিন তুলে দেয়া হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ফলে আর্থিক খাতে আমরা আশাবাদী। 

এছাড়া সরকার গঠনের ঊষালগ্নে দেশের ব্যাপক এলাকা ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয়। সেই অঞ্চলগুলোয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটে। সরকার গুছিয়ে ওঠার আগেই গোটা দেশ ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ জাতি হিসেবে আমাদের পারস্পরিক বন্ধনকে করেছে আরো মজবুত। যে জাতি একাংশের বিপদে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাদের ব্যাপারে আমরা আরো আশাবাদী। 

এখন দীর্ঘমেয়াদে কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য সংস্কার জরুরি। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় মাত্রায় পেতে চায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক চায়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায়। এগুলো নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলমান থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু এগুলো উপেক্ষা করে যত ভালো উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন গণ-অসন্তোষ বাড়তে থাকবে। 
সবার আগে মানুষ বাঁচাতে হবে। নিত্যপণ্য মূল্য সহনীয় রাখতে হবে। শিল্প কারখানায় কাজের পরিবেশ সৃস্টি করতে হবে। ছোট বড় সব ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেশের মানুষই নিজের এবং দেশের উন্নত ভাগ্য গড়ে তুলবে। শুধু সেই পরিবেশটা গড়ে তুলতে হবে বর্তমান সরকারকে।

লেখক : সাংবাদিক।







সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : কে.এম. বেলায়েত হোসেন
৪-ডি, মেহেরবা প্লাজা, ৩৩ তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০ থেকে প্রকাশিত এবং মনিরামপুর প্রিন্টিং প্রেস ৭৬/এ নয়াপল্টন, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
বার্তা বিভাগ : ৯৫৬৩৭৮৮, পিএবিএক্স-৯৫৫৩৬৮০, ৭১১৫৬৫৭, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ঃ ৯৫৬৩১৫৭, ০১৭১২-৮৮৪৭৬৫
ই-মেইল : [email protected], [email protected]