আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক স্থবিরতায় রাজস্ব আয়ে কিছুটা ভাটা পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থবিরতা থাকায় ভ্যাট আদায় কমেছে- এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে লক্ষ্য অর্জন পূরণ করতে না পারলেও অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে আছে আমদানি শুল্ক খাত। গত বছরের তুলনায় এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে এক দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থবছরের শুরুর ২ মাসে (জুলাই-আগস্ট) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ হাজার ৫১ কোটি টাকা কম আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
যদিও জুলাইয়ে পুরোটা সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন সরকার কারফিউ জারি করে, এতে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ ছিল। আর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে। চাকরিতে বৈষম্যের অভিযোগ এনে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন। সব মিলিয়ে রাজস্ব প্রশাসনে হযবরল অবস্থা বিরাজ করছিল। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাণিজ্যিক পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে। সে কারণে উৎপাদন ও রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের রাজস্ব আদায় কমে গেছে।
তারা মনে করেন, অর্থবছরের বাকি সময়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। তাছাড়া আগে রাজনৈতিক সরকারকে খুশি করতে এনবিআরের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য রাজস্ব আদায়ের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতেন। যে কারণে অর্থবছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে গরমিল দেখা দিত। এখন যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে; তা সরকারের চূড়ান্ত হিসাব ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ এই হিসাব ব্যবস্থায় আদায় বেশি দেখানোর সুযোগ নেই। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ জুলাই-আগস্টে একটা গণঅভ্যুত্থান-বিপ্লব হয়েছে। এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়নি, তবে আগের বছরের কাছাকাছি আদায় হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এনবিআর কাজ করছে।
মাঠপর্যায়ের আয়কর কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সর্বত্র ভীতিকর পরিবেশ কাজ করছে। দুর্নীতির অভিযোগ ও হয়রানির ভয়ে কেউ স্বাভাবিক কাজ করতে চাইছেন না। এনবিআর ব্যক্তি পর্যায়ে অডিট বাতিল করায় কর্মপরিধি ছোট হয়ে এসেছে। কোম্পানির অডিটও প্রায় বন্ধ। সামগ্রিকভাবে যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, লক্ষ্যের চেয়ে কম রাজস্ব আহরণের প্রভাব পড়বে বাজেট বাস্তবায়নে। এমনিতেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। সরকারের অনেক দেশি ও বিদেশি ঋণ রয়েছে। এ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ সরকারের প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। আরো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পড়ছে সামষ্টিক অর্থনীতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হবে নতুন সরকাকে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা, ডলারসংকট মোকাবিলা করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব খাতে লক্ষ্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং। যা বর্তমান তদারকি সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের ধারবাহিক ব্যর্থতা দূর করতে হলে এনবিআরে বড় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এই রাজস্ব প্রশাসন দিয়ে একটি বিশাল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
এতে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান জানান, নতুন কর অঞ্চলগুলোকে ফাংশনাল করতে ইতোমধ্যেই অফিস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যেই এগুলোকে ফাংশনাল করা হবে। করদাতাদের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য অনলাইনে রিটার্ন জমা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। অনলাইনে করদাতাদের রিটার্ন দিতে আমরা উৎসাহিত করছি। তারপরও ফিজিক্যালি কেউ যদি রিটার্ন জমা দিতে চান, তাহলে আগের সার্কেলেই তারা রিটার্ন দিতে পারবেন; যতদিন না ফাইল ট্রান্সফার হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিগগিরই এনবিআর একটি নির্দেশনা জারি করবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পরও লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বরং ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০২৩-২৪ সংশোধিত বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় কম ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। সেখানে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে সরকারি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাত লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ ছিল রাজস্ব আয় বাড়ানোর। নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও একইভাবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপ রয়েছে।
এছাড়া করছাড় কমানোর শর্তও রয়েছে। এনবিআরের হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে তিন লাখ ৭১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি পর্যায়ে এক লাখ ৩৭৮ কোটি টাকা, ভ্যাটে এক লাখ ৪০ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা এবং আয়করে এক লাখ ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে এনবিআর।
গত অর্থবছরের তুলনায় আয়কর আদায়ে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, ভ্যাটে ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে।
গত অর্থবছরে আমদানি পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। ভ্যাটে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কম আদায় হয়েছে ১১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আয়করে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।