শেখ হাসিনার শাসন অবসানের পর দু’মাস পার হতে যাচ্ছে, অথচ দেশের জনপ্রশাসন বিশৃঙ্খল অবস্থা কাটিয়ে স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়নি। গত ৮ আগস্ট রাতে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। অচলায়তন ছিন্ন করে সরকারি প্রশাসনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তাদের শপথ নেয়ার পরপরই আমলা পাড়ায় সৃষ্টি হয় চাঞ্চল্য। সাবেক সরকারের সেটকরা প্রশাসন পরিবর্তনের জন্য জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া শুরু হবার সুযোগ নিতে অনেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাছ-বিচার করার জন্য অন্তবর্তী সরকারকে সময় না দিয়ে তড়িঘড়ি ফায়দা তুলে নেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিভেদে বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে চাপ সৃষ্টির পথ বেছে নেয় অনেকেই। যা ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়ে। পদোন্নতি এবং বদলীর জন্য চাপ প্রয়োগেই সীমাবদ্ধ থাকেনি অনেকে। মাঠ পর্যায়ে পছন্দের স্থানে বদলী পেতে সংঘবদ্ধ হয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য জনপ্রশাসনে নজির বিহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি পর্যন্ত করা হয়েছে। যার রেশ এখনও কাটেনি। এ কারণে ১৬ জনের বিরুদ্ধে এরমধ্যেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের খড়গ ঝুলছে।
ব্যাপক পদোন্নতি, বদলি, পদাবনতি, পূর্ববর্তী শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্তদের চুক্তি বাতিল, বিশেষ দায়িত্বে কর্মকর্তা (ওএসডি) তৈরি এবং বাধ্যতামূলক অবসর কার্যকর করা এখনও থামেনি। যার জন্য জনপ্রশাসনে বড়ধরণের আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। নতুন চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পূরণ করায় এরমধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরী হয়েছে চাপা হতাশা।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, সরকারী কর্মকাণ্ডে ধীরগতিসহ প্রশাসন অলস হয়ে পড়েছে। ভূগছে সিদ্ধান্তহীনতায়। নীতিনির্ধারণ বা উন্নয়নের স্বাভাবিক অগ্রগতি থমকে গেছে। চিত্তচাঞ্চল্যে ভূগছেন অনেকেই। কাজের চেয়ে বেশী চলছে এসব নিয়েই গসিপ-গুঞ্জন। অথচ সাবেক সরকারের সেটকরা প্রশাসন পরিবর্তনের জন্য নেয়া পদক্ষেপগুলো নেয়া ছিল জরুরী।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৮ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ক্যাডার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। যার সুচনা হয় ১৩ আগস্ট ১১৭ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার মধ্যদিয়ে।
এক সপ্তাহের মধ্যে আরও ২২৩ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২৫ আগস্টের মধ্যে আরও ১৩১ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত করা হয়।
শুধুমাত্র ৮ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে মোট ৪৭১টি পদোন্নতি হয়েছে এবং পরদিনই সাত সচিবসহ অতিরিক্ত ৩০ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১০ জন সিনিয়র সচিব ও সচিবের চুক্তিও বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। চার সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেয়া হয়। বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এছাড়াও গতকাল পর্যন্ত ওএসডি করা হয়েছে সিনিয়র সচিব, সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ের অন্তত ১৮জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে।
অন্যদিকে ১৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত পাঁচ অতিরিক্ত সচিবকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২৮ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমানকে চুক্তিভিত্তিক সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
তারপরও বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে দশটি সচিবের পদ শূন্য রয়েছে এবং কয়েকটি জেলা কাজ করছে জেলা প্রশাসক ছাড়াই।
অন্যদিকে সারাদেশে জেলা-উপজেলার বিভিন্ন সরকারী অফিসে ক্যাডার বহির্ভুত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় দুই সহস্রাধিক কর্মকর্ত কর্মচারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। সাবেক সরকারের দলীয় আনুকল্যের কর্মপরিবেশ পরিবর্তনের সদিচ্ছার পাশাপাশি বৈষম্যের শিকার দাবীদারদের চাপের মুখে এসব পদোন্নতি বদলী ও ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়।
এরপরও কেন প্রশাসনিক স্থবিরতা? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, পদোন্নতিবঞ্চনার কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা রকম বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রশাসনের অদক্ষতা ও অপেশাদারিত্ব জনসাধারণের কাছে ন্যক্কারজনকভাবে দৃশ্যমান। পদোন্নতিবঞ্চনা একজন কর্মকর্তার জীবনে শুধু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যে প্রভাব বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন ভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত অন্যায় পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় কি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জীবনে পদোন্নতি না পাওয়ার বঞ্চনা কি ধরণের ক্ষোভ সঞ্চিত হয়েছে তা প্রথম এক সপ্তাহের অস্থিরতায় বোঝা গেছে। অস্বীকার করা যাবে না যে দীর্ঘ ১৬ বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদোন্নতি-পদায়নের সুযোগ-সুবিধা এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর সব বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের অধিকারের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন। তবে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বঞ্চনার প্রকৃতি ও গভীরতা এক রকম নয়। আপাতদৃষ্টিতে তাদের বঞ্চনাকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
প্রথম ভাগে আছেন সেসব কর্মচারী যারা রাজনৈতিক বৈরিতার শিকার হয়ে ওএসডি হিসেবে কাটিয়েছেন বা বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়েছে যাদের।
দ্বিতীয় অংশে আছেন গত ১৬ বছরে পদোন্নতি প্রক্রিয়ার কোনো এক বা একাধিকবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন এমন কর্মকর্তা। এদের অনেকেই এখন বৈষম্যের শিকার হিসেবে এক বা একাধিক পদ ডিঙ্গিয়ে চাকরির শেষ ধাপে পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন।
তৃতীয় ভাগে আছেন তারা যাদের কেউ কেউ নিয়মিত পদোন্নতি না পেয়ে একটি বা দুটি পদোন্নতি পেয়েছেন। অথবা নিয়মিত পেয়েছেন; কিন্তু তারই ব্যাচের কেউ অপেক্ষাকৃত বেশী সুযোগ পেয়ে চাকরির সর্বশেষ স্তরে পদোন্নতি পেয়ে গেছেন।
চতুর্থ আর একটি অংশ হচ্ছেন এমন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাদের বিরুদ্ধ পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা নন হিসেবে বিভাগ, অধিদপ্তর থেকে, কিংবা প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বছরের পর বছর প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
পঞ্চমত, জুনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির অধিকার হরণ করা হয়েছে।
সচিবালয় ঘুরে লক্ষ্যকরা গেছে, মন্ত্রণালয় নির্বিশেষে উপদেষ্টাদের সাথে সরাসরি যুক্তদের বাইরে কর্মচাঞ্চল্য নেই। কর্মকর্তাদের অনেকই বলছেন,"আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে আমি কখনো সচিবালয়ে এমন কর্মহীনতা দেখিনি।"
ধারণা পাওয়া গেছে যে সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া অনেক কর্মকর্তা এবং সচিবালয়ের বাইরে থেকে আনা ব্যক্তিরা তাদের নতুন ভূমিকার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে রাতারাতি এক বা দু’ধাপ অতিক্রম করে পদোন্নতি নিয়ে উর্দ্ধতন পদে আসীনদের মধ্যে এই প্রবনতা বেশী।
প্রায় সবার অভিন্ন অভিযোগ, জেলা প্রশাসন গুলো থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত সর্বত্র সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্তদের মধ্যে দাফতরিক কাজের চেয়ে নিজস্ব সুযোগ সুবিধাগুলি সুরক্ষিত করার দিকে মনোযোগ বেশী।
পদোন্নতি পাওয়া বা সদ্য অধস্তন হয়ে পড়া কর্মকর্তারা বর্তমান কর্ম পরিবেশে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তায় ভূগছেন। তারা এখনও নিশ্চিত নন যে উর্দ্ধতনরা কে কিভাবে কতটুকু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন।
এদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রশাসনিক অবস্থা ও সরকারি কার্যক্রমের ধীরগতির নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার অবশ্য জনপ্রশাসন সঠিকভাবে কাজ করছে না এমন দাবি নাকচ করে বলেছেন, "যারা জনপ্রশাসন সঠিকভাবে কাজ করছে না তারা সঠিক বলছে বলে মনে করি না। সচিবালয়, মাঠ প্রশাসন কাজ করছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আশানুরূপ কাজ করছে। সামগ্রিকভাবে, কোন উল্লেখযোগ্য সমস্যা নেই।”
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শূন্যপদ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, দ্রুত পদ পূরণের চেষ্টা চলছে। দু’এক সপ্তাহের মধ্যে সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব নিয়োগ করা হবে বলেও জানান তিনি। জনপ্রশাসনে অনুমোদিত পদসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় করে পদোন্নতির নীতি উপেক্ষিত হবার বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়মিত অবসর, মৃত্যু, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে থাকাসহ বিভিন্ন কারণে নিয়মিত কিছু পদ শূন্য হয়। বাস্তব কারণে সাময়িক কিছু বাড়তি পদোন্নতি যদি হয়, অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা সমন্বয় হয়ে যাবে বলে তিনি ধারণা দেন।
সচিবালয়ের টেবিলে টেবিলে আলোচনা থেকে মনে হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে রদবদলের প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু বৈষম্য ঘুচানোর জন্য বাছ-বিচারহীন পদোন্নতি প্রদানের কারণে প্রশাসনিক বিভেদ আরও বাড়ছে। অসন্তোষের জ¦রে ভুগছে জনপ্রশাসন।
এজন্য পদোন্নতির চাপে ঢালাও ব্যবস্থা নেয়ার আগে প্রত্যেকের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ছিল জরুরী। এউদ্দেশ্যে কর্মরত বঞ্চিত কর্মকর্তা এবং অবসরপ্রাপ্ত বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির বিষয় বিবেচনার জন্য পৃথক সেল বা উইং স্থাপন করা প্রয়োজন ছিল।
সব ধরনের পদোন্নতির জন্য বিদ্যমান বিধি সংস্কার করে বস্তুনিরপেক্ষ পদোন্নতির মানদণ্ড ও শর্তাবলি নির্ধারণ করার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে হাতে নেয়ার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। কাজটা করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে অন্যায়ভাবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাঁর প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ না থাকে। যেখানে পদোন্নতি প্রদানে ত্বরিত উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেয়াকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অন্যতম রুটিন কাজ হিসেবে বিবেচনার ব্যবস্থা থাকবে।
একই সাথে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সময়মত পদোন্নতির উদ্যোগ নেননি বা পদোন্নতি না দেয়ার জন্য কারসাজি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। কারণ তাদের অন্যায় কাজের খেসারত হিসেবেই এত কর্মকর্তা কর্মচারীকে ভূতাপেক্ষ ভাবে পদোন্নতি দিতে গিয়ে সরকারী তহবিল থেকে এখন বিপূল অংকের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে।