গেল বৃহস্পতিবার খুচরা পর্যায়ে ডিমসহ কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা, প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা, আলু ৩৫-৩৬ টাকা কেজি, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৯ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৪৯ টাকা, পাম অয়েল প্রতি লিটার ১২৪ টাকা, চিনির (খোলা) দাম প্রতি কেজি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে।
অথচ সরকারের এই নির্ধারণ থোড়াই কেয়ার করে বাজার। গত দু’দিনের বাজারের উত্তাপে সামর্থবানদের স্বাচ্ছন্দ থাকলেও ভাল নেই নির্ধারিত আয়ের মানুষ। সরকার দাম বেঁধে দেয়ায় সেসব পণ্যের তাপ কমেছে ধারনা করে হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তরা। দাম কমেনি একটি পণ্যেও। স্বাভাবিক ভাবেই জনমনে প্রশ্ন, তবে কেন এ প্রহসন?
দাম নির্ধারণ করা হয়েছে খুচরা বাজারে বিক্রির জন্য। খুচরা বিক্রেতারা বলছে, তাদের কেনা এবং বিক্রির দামে কোন অসামঞ্জস্য নেই। বরং সামঞ্জস্য নেই সরকারের মূল্য নির্ধারণে। খোলা তেলের সাথে বোতল জাত তেলে লিটারে ১০ টাকার ব্যবধান। অর্থাৎ দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলে প্লাস্টিকের একটা বোতল ও লেবেলিং মূল্য বাবদ ২০ টাকা বাড়তি দাম! তেমনি চিনির প্যাকেটজাত করা প্লাস্টিক ফয়েলের দাম হিসেবে বাড়তি গুনতে হবে ১৫ টাকা? পেয়াজ, আলু যদি পাইকারি বাজার থেকে নির্ধারণ করা দামের সাথে সমঞ্জস্যপূর্ণ দামে না পাওয়া যায় খুচরা বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই।
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যের পেছনে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে অল্প কিছু কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও সরকারের তদারকের অভাবকেই সবাই দায়ী করেন। অন্যদিকে দেশে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত কারনে টাকার দাম কমে যাওয়া এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বারবার মূল্যবৃদ্ধির মত সরকারের ভুল নীতির পাশাপাশি অতি আবশ্যকীয় পণ্য থেকে যথাসম্ভব রাজস্ব আয়ের প্রবনতা মূল্যস্ফীতির অদৃশ্য কারণ।
গত দেড় দশকে শুল্কবাধা সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কিছু বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানি ও মিল মালিকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ করে দেয়া হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানান পরিস্থিতির অজুহাতে তারা এখন ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি ও উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিদেশ থেকে কাঁচা চিনি এনে পরিশোধন করে দেশে বিক্রি করে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি। এ সব প্রতিষ্ঠানই দেশের প্রধান চিনি সরবরাহকারী। দেশে পরিশোধন শিল্পের নামে ভোজ্যতেলের ৮৮ শতাংশই আমদানি করে চারটি কোম্পানি। দেশে পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার সিংহভাগ উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি কোম্পানি, সেই সঙ্গে ডিম ও মাংসের বাজারেরও বড় একটি অংশ তাদের দখলে।
বাজারে পন্যের সরবরাহ তথা বিপনন ব্যবস্থাও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় এসবের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধিও তারাই করতে পারে। উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে সরকারের তদারকির এখতিয়ার থাকলেও উচ্চপর্যায়ের কর্তাদের যোগ সাজোশ এই ভারসাম্যের ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে রেখেছে।
লক্ষ্য করা গেছে, একসময়ের সরকারী কর্মকর্তারাই অবসর গ্রহনের পর সংশ্লিষ্ট বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অথবা উপদেষ্টা হন। তারাই সরকারের সাথে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণের মিটিং-সিটিং করেন। সরকারের পক্ষে দায়িত্বে থাকা জনপ্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সাথে অবসরে যাওয়া তাদেরই সাবেক বস যখন মুখোমুখি আলোচনায় বসেন অধিকাংশ সময়েই নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বার্থ সংরক্ষণই সেখানে মূখ্য হয়ে যায়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ থাকেনা।
উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষিজ পন্য আমদানি নর্ভরতা কমানোর কথা সব সরকারের গতবাঁধা। অথচ যেসব খাতের বিকাশ হলে আমদানিনির্ভরতা হ্রাস পেয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যায়, সেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে অবহেলা করার খেসারত গুনতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। যেমন চিনি; বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো একসময় বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত, যা বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করত। কিন্তু ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে ৬টির উৎপাদন বন্ধ রাখায় দেশীয় উৎপাদন কমে ২১ হাজার টনে নেমে এসেছে। এতে দেশের চিনি খাত প্রায় শতভাগ আমদানিভিত্তিক বেসরকারি কলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বাজার। এ কারণে চিনির বাজারের ওপর সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভারতীয়দের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। সরকার যখন ব্যবসায়ীদের কথামতো চিনির দাম কেজিপ্রতি ১২০ টাকা ঘোষণা করে, তার আগে থেকেই দেশের বাজারে চিনি ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। অভিযোগ রয়েছে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চিনির এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো হয়েছে। চিনি-সংকটের পেছনে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ানোর কথা বলা হলেও গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ হলো, বেসরকারি আমদানিকারকদের ওপর একক নির্ভরশীলতা।
আসলে বাজার চলছে সেট হয়ে যাওয়া নিজস্ব নিয়মে। যে নিয়মের মূলকথা হচ্ছে- চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য। চাহিদা পুরণে উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা আমদানি ও যোগান নিশ্চিত করতে সিন্ডিকেট মুক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার প্রেসক্রিপশনও দীর্ঘদিনের।
উভয় ক্ষেত্রে আমদানি বানিজ্যে বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সিন্ডিকেট সহায়ক না হয়ে আইনানুগ হওয়া জরুরি। আমদানির কনসাইনমেন্ট ভিত্তিক মূল্য অনুমোদন হবার কথা। অথচ একই মূল্য সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য করে বাজারের প্রতিযোগিতার চরিত্র নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
কৃষি, প্রাণী সম্পদ, ফিশারিজ সর্বত্র রাজস্ব আদায়কে প্রধান লক্ষ্য বিবেচনা করে করপোরেট পুজি বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা মুলক বাজারকে প্রতিযোগিতাহীন সিন্ডিকেশনের জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। সরকারের নীতিমালায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিংকে সুবিধা দেয়ায় এসএমই বিনিয়োগ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের একটি ব্যখ্যা হলো, বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়, কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির কারণেও মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়াই হলো মূল্যস্ফীতি। বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে বেশি টাকা দিয়ে তখন পণ্য বা সেবা কিনতে হয়।
তাদের মতে মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে ক্রমবর্ধমান ভোক্তাব্যয়ে লাগাম দিতে হবে। আভ্যন্তরীন চাহিদার তীব্রতা প্রশমনের অস্ত্র হচ্ছে বাজেট এবং মূদ্রানীতি। বাজেট যদি সম্প্রসারণমূলক হয় তাতে বাজারে মুদ্রাসরবরাহ বাড়ে। সেক্ষেত্রে মূদ্রানীতি এবং কর ব্যবস্থা বাজারের ভারসাম্য আনে। বিগত সরকারের কয়েকটি বাজেটে সেই চেষ্টার অভাব লক্ষ্য করা গেছে।
আবার শুধুমাত্র মুদ্রানীতি ব্যবহার করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যেখানে বাজার অব্যবস্থাপনা বেশি সেখানে শুধু মুদ্রানীতি কাজ করে না। আমাদের দেশে মার্কেট ম্যানিপুলেশন (বাজার কারসাজি), অলিগো-পলিক (একচেটিয়া) আচরণের কারণে বাজারে চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে মূল্য কমার স্বাভাবিক প্রবণতা বাধাগ্রস্ত করে। এর একটা উদহরণ হলো– দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য যথেষ্ট সরবরাহ থাকার পরেও কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে এ হার কিছুটা কমলেও তা দুই অংকের ঘরেই রয়েছে। গত মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বিবিএস প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংস্থাটির দেয়া মূল্যস্ফীতির তথ্যে ব্যবধান অনেক। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরও আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক।
তারপরও বলতে হয়, জনমনে বাজার পরিস্থিতিতে সন্তুষ্টি আনতে হলে পরিসংখ্যানই যথেষ্ট নয়। মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ আনতে যত দ্রুত সম্ভব মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। পণ্য ও মুদ্রা সবরাহে বাজারের চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়ার সাথে সাথে বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া এবং সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। আর এরজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।