বর্তমানে বৈধ-অবৈধ রিকশায় গোটা ঢাকা শহর যেন রিকশার শহরে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো একদিকে যেমন তীব্র যানজট সৃষ্টি করছে, তেমনি সড়কে অন্য পরিবহণের গতিও কমিয়ে দিচ্ছে। একদিকে ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা অন্যদিকে যোগ হয়েছে অতিরিক্ত ব্যাটারিচালিত রিকশার চাপ। সবমিলিয়ে যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী। গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। শুরুতে শিক্ষার্থীরা সড়কের হাল ধরলেও এখন তারা ফিরে গেছে ক্লাসে। পুলিশ সড়কে ফিরলেও গা-ছাড়া ভাব। ফলে এরপর থেকে শুরু হয়েছে মানুষের দুর্ভোগ। কোনভাবেই যেন এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই নাই। ঘর থেকে বের হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। এতে অফিসগামী মানুষজন সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন।
ঢাকায় চলাচল করা গণপরিবহনের মধ্যে অন্যতম একটি পরিবহণ রিকশা। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য রিকশার বিকল্প নেই। তাই রিকশার উপর অনেককে ভরসা করে রাজধানীতে চলাচল করতে হয়। তবে বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে সৃষ্ট যানজটে জনগণের ত্রাহি অবস্থা। কোনভাবেই যেন এর থেকে পরিত্রাণ নাই ঢাকাবাসীর।
রাজধানীর প্রত্যেকে এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব সড়কগুলো রাজধানীর প্রধান সড়কের সাথে মিলিত হয়। প্রধান সড়ক ছাড়া এমন কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই যেখানে এসব রিকশা চলছে না। এলাকাগুলোর প্রবেশমুখে ভিড় করে থাকে এসব রিকশা। এসব যানবাহনের চালকদের নেই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স, নেই কোনো প্রশিক্ষণ। এমনকি তারা কোনো ট্রাফিক আইনের ধারও ধারেন না। তারা বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালিয়ে থাকেন। এতে করে রাস্তায় বেড়েই চলেছে বিশৃঙ্খলা, যানজট ও দুর্ঘটনা।
ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো চলে। অন্য যানগুলোকে তোয়াক্কাই করেন না। তাদের চাইতে আমাদেরই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কোনো লুকিং গ্লাস নেই, যখন-তখন রিকশার মোড় ঘুরিয়ে দেন চালকরা। পুরো রাস্তা দখল করে ওভারটেকিং করা তো তাদের কাছে এখন স্বাভাবিক বিষয়।
রাজধানীর শ্যামলীর শিশুমেলার সামনে আব্দুর রহমান নামের এক ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকের সাথে কথা হয়, অবৈধ হওয়ার পরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান কেন এমন প্রশ্নে রহমান বলেন, ‘এখন গ্যারেজগুলাতে ব্যাটারি রিকশা বেশি। আর এই রিকশা চালাতেও আরাম। অবৈধের বিষয়টা গ্যারেজ মালিক জানে।’ তবে দ্রুত গন্তব্য পৌঁছানো, অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিংয়ের প্রবণতার বিষয়টি ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন।
রাজধানী ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ঠিক কত? তার সঠিক হিসাব পাওয়া দুষ্কর। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ১২ লাখের মতো। এর সাথে সাম্প্রতিক বছরসমূহে যোগ হয়েছে কমপক্ষে আড়াই থেকে ৩ লাখ ব্যাটারীচালিত রিকশা। সবমিলিয়ে এই সংখ্যা ১৫ লাখের মতো হবে।
এদিকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্যমতে, ঢাকায় কমপক্ষে পাঁচ লক্ষাধিক রিকশা চলাচল করে এবং ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষই রিকশায় চড়ে। ২০১৫ সালের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রকাশনায় এ সম্পর্কিত একটি বিশ্বরেকর্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গত ১৫ মে ২০২৪ বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইক বন্ধে ঘোষণা দিলেও এটি কার্যকর করতে পারেনি। এ ঘোষণার মাত্র দুদিন পরই আন্দোলনের মুখে আবারো তা চালু রাখার নির্দেশ দেয় সরকার। তবে, শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা শহরে ফিডার রোডে (মূল সড়ক নয় এমন রাস্তা) এই তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা চালু থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া সারা দেশের ২২টি মহাসড়কে এসব বাহন বন্ধই থাকবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়েছিল। এরপর থেকে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধ থাকলেও ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের অনুপস্থিতিতে প্রধান সড়কগুলোতে আবারো রিকশা এবং ব্যাটারিচালিক রিকশা চলাচল শুরু হয়, যা এখানো অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে এসব রিকশা রাজধানীবাসীকে প্রতিনিয়ত অসহনীয় ভোগান্তি উপহার দিয়ে চলেছে।
এদিকে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোয় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের দাবিতে গত ২৬ আগস্ট শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পায়ে চালিত রিকশার চালকরা। সে সময় তারা ‘চলবে না চলবে না, অটোরিকশা চলবে না’, ‘অবৈধ অটোরিকশা চলতে দেওয়া হবে না’, ‘বাংলাদেশে বৈষম্য মানি না মানবো না’সহ নানান স্লোগান দেন। মূলত মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করাসহ ৭ দাবিতে বিক্ষোভ করেন তারা। রিকশা চালকদের অন্য দাবির মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মতো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে রিকশা মালিকানার নতুন লাইসেন্স প্রদান ও পুরাতন লাইসেন্স নবায়ন করা; সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ও বৈধ লাইসেন্সধারী রিকশা পেশাজীবীদের স্বার্থে ঢাকা উত্তর/দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে চালক লাইসেন্স প্রদান করা; অসুস্থ্য চালকদের ফ্রি-ফ্রাইডে মেডিকেল চিকিৎসা প্রদান করা; ঢাকা উত্তর/দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশা পেশাজীবীদের ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
শহরে পায়ে চালিত রিকশার সুনাম থাকলেও বর্তমানে পায়ে চালিত ও অটোরিকশা চালকরা যে যেভাবে পারছে যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। যাত্রী নিয়ে উল্টো পথে চলাচলে অন্য গাড়িগুলো স্বাভাবিকভাবে যেতে পারছে না। এতে একবার যানজটের সৃষ্টি হলে সেটি দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত থাকছে।
ঢাকার সব রাস্তায় দেদারছে চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা মাঝ দিয়ে চলাচল করছে। হর্ন দিলেও সরে না। এতে গাড়ির চাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি যানজটে নাকাল হচ্ছে নগরবাসীর। তাই এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল জরুরী ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। অন্যথায় দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে যানজটে অতিষ্ঠ এই ঢাকাবাসীর।
লেখক: তরিকুল ইসলাম,
অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন)
স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।