দেশের অর্থনীতি ব্যাংকনির্ভর। ব্যাংকের খারাপ সূচকের প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়ে। এর মধ্যে টানা কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে। এ খাতে এখন তার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। অথচ আর্থিক খাতের বড় শক্তিই হওয়ার কথা ছিল আস্থা ও বিশ্বাস। যেমন- আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে আমানতকারীরা তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ জমা রাখে ব্যাংকে। আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও আস্থা ও বিশ্বাসের বিনিময়ে কাগজপত্র জামানত রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেন ঋণগ্রহীতাদের হাতে। অথচ সেই আস্থা আর বিশ্বাসটা এখন প্রায় তলানিতে।
রেকর্ড খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। এসব দুর্বলতা দেখে ব্যাংকে টাকা রাখার মতো আস্থা পাচ্ছেন না অনেক গ্রাহক। অনেকেই আবার তুলে নিচ্ছেন আমানতের টাকা। এ অবস্থায় দৈনন্দিন ব্যাংকিংসেবা ও স্বাভাবিক লেনদেন চালু রাখতে ব্যাপক হারে ধার করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ডজনখানেক ব্যাংক আমানতকারীর চেক নগদায়ন করতে পারছে না। তাদের অ্যাপেও লেনদেন করা যাচ্ছে না। যা দেশের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। এর প্রভাবে আস্থাহীনতা বিরাজ করছে পুরো ব্যাংক খাতে। দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে সংস্কারও শুরু করেছেন নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু এই সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার কারণে তাৎক্ষণিক সুফল পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। আবার তাদের মনে স্বস্তি ফেরাতে পারে এমন কোনো বার্তা বা লক্ষণও স্পষ্ট নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ডলার বিক্রি বন্ধ, রেমিট্যান্স থেকে আয় বাড়ানো এবং সরকারের ঋণ কমিয়ে তারল্য বৃদ্ধির কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকে এগুলোকে সময়োচিত পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও কেউ কেউ উল্টো চিত্র তুলে ধরতে উদাহরণ হিসেবে বিষয়টিকে ‘প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিয়ে ক্যানসারের’ চিকিৎসা করার মতো অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকের অবস্থাই দুর্বল। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যার ৯টি ইতোমধ্যে রেড জোনে চলে গেছে। অপর ৩টি রেড জোনের খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের অবস্থান ইয়েলো জোনে। এর বাইরে আরও ২৬টি ইয়েলো জোনে অবস্থান করছে। অন্যদিকে মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ৮টিই বিদেশি ব্যাংক। অর্থাৎ গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৮টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচারে রেড জোনের ব্যাংকগুলো সবচেয়ে খারাপ (পুওর) এবং ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলো দুর্বল (উইক)। আর গ্রিন জোনের ব্যাংকগুলো ভালো মানের (গুড)। অর্থাৎ দেশে এখন সবলের চেয়ে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি।
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাট, অব্যবস্থাপনা আর স্বেচ্ছাচারিতায় বেশ কিছু ব্যাংকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকটসহ বহুবিধ সংকটে জর্জরিত এসব ব্যাংক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে তাই বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাংক খাতকে সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনা। সেই লক্ষ্যে চলছে সংস্কার। তবে ব্যাংক খাতের ক্যানসার হিসেবে গণ্য করা হয় যে খেলাপি ঋণকে; তা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে খুবই ধীর লয়ে। ফলে বিদ্যমান তারল্য সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই জটিল চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে এত দিন অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকা আমানতকারীরা এখন তাদের সঞ্চয় নিয়ে আতঙ্কবোধ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানে আপাতত চারটি পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ডলার কিনে যে টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করত ব্যাংকগুলো, এখন তা ব্যাংকিং সিস্টেমেই থাকছে। দ্বিতীয়ত বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রেখে রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের কাছে তরল মুদ্রা বাড়ছে। তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে সরকারের ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে এতে রাজি হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন গভর্নর। আর সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়াতে নেওয়া চতুর্থ পদক্ষেপটি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই গ্যারান্টার হয়ে সবল ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তবে টাকা ছাপিয়ে কোনো ব্যাংককে সহায়তা দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সব সমস্যা এক মাসের মধ্যে সমাধান করা যাবে না। আমরা ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছি, এক্সচেঞ্জ রেটি স্থিতিশীল থাকায় রেমিট্যান্স বাড়ছে। আর সরকারি খাতে ঋণ কমানোর চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা ব্যাংক খাতের ঋণের লক্ষ্য ৫০ হাজার কোটি টাকা কমাবে। আর গ্যারান্টার হয়ে সবল ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকের টাকা সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে এসব পদক্ষেপকে যথার্থ মনে করছেন না ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তারা বলছেন, আগে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হতো; আবার ডলার বিক্রি করে উঠিয়ে নেওয়া হতো। এখন ডলার বিক্রি এবং টাকা ছাপানো দুটোই বন্ধ করা হয়েছে। এটা মূল্যস্ফীতি এবং রিজার্ভ সমস্যার সমাধানে কার্যকরী হলেও তারল্য বাড়ছে না। আবার রেমিট্যান্স আগের চেয়ে খুব একটা বাড়েনি। আর সরকারের ঋণ কমলে বেসরকারি ঋণ বাড়বে, এটা তারল্য সমস্যা দূর করবে না। সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ লুট হওয়া অর্থ ফেরত আনা। বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি ধীরগতিতে করছে। ফলে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। সাধারণ ক্ষুদ্র আমানতকারীরা বড়ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছে।
নাম প্রকাশ না করে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এখন যেটি করা দরকার তা হলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি তালিকাভুক্ত করার যে পলিসি আমাদের হাতে আছে; তা ব্যবহার করে কিছু বড় ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা। এতে বিদ্যমান সংকট অনেকখানি কেটে যাবে। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বড় পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। কিন্তু বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের কথা বলে যে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে; তার চাপ সহ্য করতে পারছে না ব্যাংক খাত। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে যদি কিছু ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়; তাহলে তারা বউয়ের গয়না বিক্রি করে হলেও জনগণের লুটে নেওয়া অর্থ ফেরত দেবে।
অপর একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, প্রতিদিন মানুষ আমাদের কাছে এসে নিজেদেরই টাকা পাওয়ার জন্য যেভাবে আহাজারি করেন, তা সহ্য করা কঠিন। কত মানুষের চিকিৎসা হচ্ছে না। হাজার হাজার মানুষের বেতনের টাকা আটকে গেছে। অনেকে বিদেশে যাবেন কিন্তু টাকা দিতে পারছি না। এটা তো তাদেরই টাকা। এখন আমরা যদি অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে টাকা ফেরত দিই; তাহলে কি তারা আর আমাদের কাছে আসবে নাকি টাকা নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। বরং আমরা যদি বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু খেলাপি ঋণের অর্থ ফেরত পেতাম তাহলে গ্রাহক আশ্বস্ত হতেন যে ব্যাংক নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। তখন তারা আবার আমানত জমা করতেন। তা ছাড়া ধার করা টাকাইবা কয়েক দিন পর ফেরত দেব কীভাবে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা এখনই কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণে আমরা আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করেছি। এতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরও বাড়বে। তবে এটি আদায়ের কৌশল ঠিক করবে টাস্কফোর্স। তারল্য সংকট মোকাবিলায় আপাতত সবল ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকে টাকা ধার দেওয়ার পদক্ষেপকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।