ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, আত্মরক্ষার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু, কিংবা রিমান্ডে নেয়া আসামির মৃত্যুই শুধু নয়; ‘গণপিটুনি’ তথা ‘মব ট্রায়াল’ বা ‘মব (ইন) জাস্টিস’ এর মাধ্যমে যেকোনো মৃত্যুও ‘বিনাবিচারে হত্যা’। গত সরকারের প্রতিহিংসা আর দমনমূলক বিচারবহির্ভূত সহিংসতার বিপরীতে এখন ‘ক্ষুদ্ধ-উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার’ অভিন্ন মানসিকতার প্রকাশ। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাবে ‘ন্যায়বিচার’ এর পরিবর্তে ‘উচিৎ বিচার’ দেয়ার জন্য আইন হাতে তুলে নেয়ার এই প্রবণতা সমাজের জন্য ভয়ংকর।
অর্থাৎ সরকারি বাহিনী ছাড়াও বিনা বিচারে হত্যার মতো অন্যায় অপকর্মটি হতে পারে। হত্যাকান্ড চাপাদিয়ে পার পাওয়ার এ ধরনের ঘটনা কোনো সুস্থ সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিছু মানুষের ‘ন্যায়পরায়ণতা’র অন্ধ নির্বোধ আত্মতৃপ্তি এবং উন্মাদ নিষ্ঠুরতা, প্রতিহিংসা আর নানাবিধ স্বার্থান্বেষণ দেশ ও সমাজকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সে সচেতনতা লোপ পেলেই কেবল এ প্রবণতা দেখা দেয়। কোনো দেশে সরকারের পতন অস্বাভাবিক পথে হলে প্রথম কিছুদিন এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে। এক ঘটনা অন্য আরও ঘটনা ঘটানোর পথ পরিষ্কার করে দেয়। তাই একে বল্গাহীন ছেড়ে দেওয়া যায় না। যদি দেওয়া হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী।
স¤প্রতি বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি ‘মব জাস্টিস’ ঘটেছে। থানায় হামলা করে অগ্নিসংযোগ, পুলিশ হত্যা পর্যন্ত হয়েছে ‘মব (ইন) জাস্টিস’-এর কাভারে। গণপিটুনি, গণধোলাইয়ের ইংরেজি ভার্সন এই মব-জাস্টিস। জনরোষের আড়ালে অপরাধীর নিজেকে গোপন রাখার কৌশল। অশান্ত দিনগুলোতে বিভিন্ন কারণে কথিত জনতার রোষে এই নামে ঘটে চলা হত্যার হিসাব করলে সংখ্যাটা ছোট হবে না।
ঘটনার শিকার রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, খুলনায় উৎসব মন্ডল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন হত্যা সাম্প্রতিক আলোচিত মব জাস্টিসের ঘটনা।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পাবলিক টয়লেটের সামনে মোবাইল চুরির অভিযোগে ৪৫ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক পুরুষকে পিটিয়ে হত্যা, সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর রাতে লক্ষ্মীপুরে বাড়িতে হামলা করে নুর আলম নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। খাগড়াছড়িতে মামুনকে চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা নিয়ে পাহাড়ে চলছে গোষ্ঠীগত সহিংসতা। যার পরিণামে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতায় আরো ৪ জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও মব ট্রায়ালে মৃত্যুর খবর যেমন আছে তেমনি অনেক জায়গায় বহু শিক্ষককে অপমান-অপদস্থের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাও মব ট্রায়াল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষককে তারই ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে গলায় জুতার মালা পর্যন্ত পরানো হয়েছে। ডাকাত, পকেটমার আখ্যা দিয়ে রাজপথে ধাওয়া করে জনরোষ সৃষ্টি করে গণপিটুনির ঘটনাও সংবাদ হয়েছে।
জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সরকারি কোনো সুবিধা পাওয়ার কারণে ইর্ষান্বিত কারো চাপা ক্ষোভের রোষানলে পড়তে হয় কিনা সে হিসাব করতে হচ্ছে একাধিক বার। শুধু কি তাই! আধিপত্য বিস্তার, এলাকার নিয়ন্ত্রণ কিংবা তুচ্ছ ঘটনা থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ সবকিছুর জন্যই ধনন্তরী মহৌষধ হয়ে উঠেছে মব জাস্টিস।
দেশে গণপিটুনি জনরোষের সুযোগ নেয়া অপরাধের জন্য আলাদা কোন আইন নেই। গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনায় দন্ডবিধিতে মামলা হয়। শত শত লোক গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ায় প্রকৃত অপরাধী, আলামত ও সাক্ষী পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। মামলা করতে দেরি হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য আমাদের সাক্ষ্য আইনে এখন ভিডিও, ফটো, অডিও গ্রহণ করার বিধান আছে। তাই অপরাধীদের শনাক্ত করা আগের চেয়ে সহজ। সাক্ষী না পাওয়া গেলেও ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে বিচার করা যায়। তবে তার নজির খুব বেশি নেই।
এমন পরিস্থিতিতে একের পর এক এধরণের ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব ট্রায়াল আতঙ্ক’ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় নিরীহ অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ঘর থেকে বেরোতে দু’বার চিন্তা করতে শুরু করেছে। গত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এমন অভিযোগে না জানি কখন ’মব জাস্টিস” এর শিকার হতে হয় এই ভয়ে!
হতে পারে কারও অতীতের কোনো কর্মকান্ড বিতর্কিত ছিল। কিংবা কেউ কেউ পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। তাই বলে তাদের ওপর চড়াও হওয়ার অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। তার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। দেশে আইন আছে, আদালত আছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যে কেউ আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। তা না করে বিচারের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলে রাষ্ট্র যদি তা না দেখার ভান করে এড়িয়ে চলে তাহলে সে রাষ্ট্র কখনও সভ্যরাষ্ট্র হিসেবে সামনে এগোতে পারে না।
এ ধরনের ‘মব জাস্টিস’ প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর নামান্তর। যা একটি দেশের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নাজুক করে তুলতে পারে। যার উদাহরণ হয়ে সামনে রয়েছে মোল্লা শাসিত আফগানিস্তান।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ২০১৫ সালের ১৯ মার্চের ফারখুন্দা মালিকজাদার মব ট্রায়ালে হত্যার ঘটনা এখনও বিশ্ব ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি। ২৭ বছর বয়সী সেই শিক্ষিত আফগান নারীকে সেদিন প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছিল উত্তেজিত জনতা। ফারখুন্দার বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছিল তিনি কোরআন পুড়িয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হওয়ার পর পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে দেখাযায়, কোরআন পোড়ানোর অভিযোগটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা। স্থানীয় এক মোল্লার সঙ্গে ভিন্ন এক প্রসঙ্গে তর্ক করেছিলেন ফারখুন্দার। মোল্লা ও তার অনুসারীরা যা ঔদ্ধত্য বিবেচনা করে ফারখুন্দার বিরুদ্ধে কোরআন পোড়ানোর মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। যা শুনে জনতা ফারখুন্দাকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ফারখুন্দা হত্যা মামলার রায়ে তিন আসামিকে ২০ বছর এবং আটজনকে ১৬ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সেই একটি মব ট্রায়ালের পরপর বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে একই কায়দায়। মোল্লাতন্ত্র আফগানিস্তানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এই পথ বেছে নেয়। পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক শত্রুতারও প্রতিশোধ নিতে থাকে এভাবে।
মনে রাখা উটিৎ, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বা গুজব ও ধারণার বশবর্তী হয়ে কারও ওপর আক্রমণ বিশ্বজনীন মানবাধিকারের পরিপন্থি। গণতন্ত্র ছাড়া যদি মানবাধিকার বিকশিত হতে না পারে; মানবাধিকারকে অস্বীকার করে গণতন্ত্রকেও এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মতো আকারে আয়তনে ছোট দেশে মব ট্রায়ালের প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা ও অসুস্থতা এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছড়াতে সময় লাগে না।
মনে রাখতে হবে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নানা কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলে চিড় ধরে আছে, যা স্বাভাবিকতায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। এ অবস্থায় যদি সবাই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চায়, তাহলে যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।
মব ট্রায়াল বা মব জাস্টিস, যে নামেই অভিহিত হোক না কেন স্পষ্টতই তা মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর ভিত্তি যুক্তিহীন আবেগ। যা মানুষকে বিচারশক্তিহীন করে তোলে। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর ফল হয় ভয়াবহ। অরাজক যেকোনো চর্চা চলতে দিলে তার শিকার যেকোনো সময় নিজেও হতে পারি, এই বোধ তখন হারিয়ে যায়। যা এমনকি ভ‚রাজনৈতিক বিপদ পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। পরিণতিতে দেশ আপতিত হয় গভীরতর সংকটে, যা ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকে এক অকার্যকর রাষ্ট্রে। (আফগানিস্তান যার উদাহরণ।)