ইলিশ প্রকৃতির দান। সেই দান ভোক্তার ঘরে আসে সাত হাত ঘুরে। প্রতি হাত বদলেই হয় মূল্য সংযোজন। সাথে শিকার থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি। এতগুলো মধ্যস্বত্বভোগীর লাভের অঙ্ক যোগ হয়ে তা চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে কারণে বিদেশে না পাঠালেও কমছে না ইলিশের দাম। পরিস্থিতি এমন যে গরিব তো দূরে থাক মধ্যবিত্তের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ হয়ে গেছে ইলিশ মাছ।
রপ্তানি বন্ধের পরও বেড়েছে ইলিশের দাম। বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়লেও চাহিদার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। ধরাপড়া ইলিশ মজুদের ব্যবস্থা অতীতে ছিলনা। এখন সারা বছর বিক্রির জন্য কোল্ডস্টোরে মজুদ হয়। ভরা মৌসুমে মাছ যায় কোল্ডস্টোরে। সচ্ছলরাও একই সঙ্গে বাজারে হামলে পড়েন। কোরবানির মাংসের মতো অবস্থাশালীদের ঘরে ঘরে ডীপফ্রিজে সারা বছরের জন্য তখন মজুদ হয় এক আধমন ইলিশ মাছ। ফলে ভারতে রপ্তানি বন্ধের কোনো প্রভাব এবার বাজারে পড়ছে না। ভরা মৌশুমেও তাই ইলিশের দাম কমেনি।
বরিশালের পাইকারি বাজারে এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ হাজার টাকা মন দরে। ৪২ কেজিতে মন হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ে প্রায় সাড়ে ১৪শ টাকা। খুচরা বাজারে যা বিক্রি হয় ১৬ থেকে ১৮শ টাকা।
চাষের মাছে উৎপাদন খরচ আছে, সাগর নদীতে প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা ইলিশের দাম এত কেন? বরগুনার মাছের ট্রলার মালিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর দেয়া হিসাব হচ্ছে, একটা ট্রলার বানাতে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়। ট্রলারগুলো কাঠের তৈরি। এগুলোর আয়ু ১০ বছরের বেশি নয়। এটি একটি বড় বিনিয়োগ। সুতরাং ট্রলারে কী পরিমাণ মাছ এলো, তার সঙ্গে এই বিনিয়োগ হিসাব করতে হয়। কয়েক মাস পরপর ট্রলার মেরামত করতে হয়। তাতেও আছে অনেক খরচ। ১৪-১৫ জন মাঝি মাল্লা নিয়ে একটি ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে গেলে তেল-মবিল, গ্যাসের সিলিন্ডার, বরফ আর ৮-১০ দিনের বাজার মিলিয়ে নগদে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয় মালিকের। সেই সঙ্গে যোগ হয় মাঝি মাল্লাদের দাদন বাবদ দেয়া টাকা। অর্থাৎ প্রতি ট্রিপে বিনিয়োগ ও খরচ মিলিয়ে গড়ে ব্যয় হয় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। আর সব ট্রিপে যে মাছ মেলে তাও কিন্তু নয়। অনেক সময় ট্রলার ফেরে শূন্য হাতে। তখন ট্রিপের পুরো টাকাটাই লোকসান।
তিনি বলেন, ‘এই হিসাবের সাথে আছে ঝড়ে ট্রলার ডোবার শঙ্কা। জ্যৈষ্ট মাস থেকে ৩০ আশ্বিন পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম। সাগরে ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের মৌসুমও এটাই। আমাদের ঋণ দেয় না কোনো ব্যাংক। ট্রলার কিংবা জালের ইন্স্যুরেন্সও করে না। বিনিয়োগের পুরো টাকা যেমন পকেটের, তেমনি বিপদে মেলে না ক্ষতিপূরণ। বলতে পারেন অন্য মাছ ধরে আয় করার কথা কিন্তু এসব ছোট ট্রলারের মূল আয় ওই ইলিশই। যে কারণে ইলিশের দিকেই তাকিয়ে থাকে সবাই। এর মধ্যে প্রজনন মৌসুম আর মা-ইলিশ নিধনে নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে ৮৭ দিন বন্ধ থাকে মাছ ধরা। বাকি ৬৩ দিনে ৪-৫ বার সাগরে যেতে পারে একটি ট্রলার। এই ৪-৫ বারে যেটুকু মাছ মেলে তার ওপরই নির্ভর করে লাভ-লোকসানের হিসাব।’
বরগুনা থেকে ইলিশের ট্রলার ব্যবসায়ী রফিকুল আলমের হিসাবও অভিন্ন। তার মতে, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে ইলিশ বাজারে। তার দেয়া হিসাব হচ্ছে, ট্রলার বানানো ও মেরামতের খরচ, প্রতি ট্রিপের জন্য পানি এবং খাবার বাবদে বাজার খরচ, আর জেলেদের দেওয়া দাদনের টাকা। সাগরে মাছ ধরতে গেলে প্রতি মন ইলিশে লাগে দেড়শ টাকা দামের এক ক্যান বরফ। ঘাটে আসার পর সংরক্ষণ ও দেশের বিভিন্ন স্থানের আড়তে পাঠানোর জন্য আবারও বরফ দিয়েই পাঠাতে হয় তা। তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পরিবহণ সেক্টরেও। আগে যেখানে ঢাকায় এক ট্রাক ইলিশ পাঠাতে খরচ হতো ১৮-২০ হাজার সেখানে এখন ৩৫/৪০ হাজার টাকায়ও পাঠানো যায় না। দাম বেড়েছে মাছ প্যাকিংয়ের বাক্স, হোগলাসহ অন্যান্য উপকরণের। একটি ট্রলার সাগরে গিয়ে গড়ে যদি ২০ মন ইলিশও পায় তাহলে কত টাকায় বিক্রি করলে এসব খরচ উঠবে? ধরা পড়া সব ইলিশ তো আর কেজি সাইজের হয় না। ৩-৪শ গ্রাম ওজনের ইলিশও ওঠে জালে। তাই গেল বছরও খরচের কারণে কেজি আকারের যে ইলিশের দাম ছিল প্রতি মন ৪২ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এ বছর সেই দাম দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে।
ট্রলারের মাঝি ইমরান হোসেনের সঙ্গে কথা হয় ইলিশ শিকার নিয়ে। তিনি জানান, মৌসুম শুরুর আগেই একজন মাঝি নেতৃত্ব দিয়ে জেলেদের সংগঠিত করেন। বড় ট্রলারে ১৮ জন, মাঝারি ট্রলারে ১৪ থেকে ১৬ জন এবং ছোট ট্রলারে ৮ থেকে ১২ জন জেলে থাকে। দলে থাকে একজন বাবুর্চি, একজন ইঞ্জিনচালক, একজন সহকারী মাঝি ও বাকিরা জেলে। ট্রলার মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব জেলেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দাদন দিয়ে এক মৌসুমের জন্য মাছ শিকার করতে চুক্তি করা হয়। শর্ত অনুযায়ী সেই মৌসুমে চুক্তিতে থাকা জেলেরা অন্য কোনো ট্রলারে মাছ শিকারে যেতে পারবেন না। এরপর সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে জেলেদের ১০ দিনের খাবার, ইঞ্জিনের তেল ও বরফ কিনে দেন মালিক।
চুক্তি থাকে ওই ট্রলারে যে মাছ পাওয়া যাবে সব মাছ আড়তদারকে দিতে হবে। মাছ শিকার করে ফেরার পর নিলামে তোলা হয়। এরপর নিলামে ডাকা সর্বোচ্চ দামে দাদন দেয়া আড়তদার এসব মাছ কিনে নেন। মাঝি ইমরান জানান, ৫০ লাখ টাকার মাছ বিক্রির পর হিসাব হয় ট্রলারমালিকের সঙ্গে। এই টাকা থেকে প্রথমেই বাজার, ডিজেলসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ খরচের টাকা কেটে নেয়া হয়। বাকি টাকার অর্ধেক ট্রলারমালিকের। এরপর যা থাকে তা ২০ ভাগ করা হয়। এই ২০ ভাগের মধ্যে মাঝির ২ ভাগ এবং বাবুর্চি এক ও ইঞ্জিনচালকের এক ভাগ। ১৬ জন জেলে প্রত্যেকে এক ভাগ করে পায়।
বরিশালের ইলিশ ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সাহা আক্ষেপ করে বলেন, ‘নিজেরাও এখন ইলিশ খেতে পারি না। একটা ইলিশের দামে যখন দুজন লেবারের মজুরি হয় তখন খাওয়ার সাহস থাকে না। আড়তের ভাড়া দিতে হয়। দুজন সরকারের (ম্যানেজার) বেতন, লোড-আনলোডের লেবার মিলিয়ে বিশাল খরচ।’
তার বক্তব্য, সাগরের ইলিশ নয়- আগে নদ-নদী থেকে স্থানীয় জেলেদের ধরা মাছের দামেই ইলিশের বাজার ওঠানামা করতো। এখন নদ-নদীতে যারা ইলিশ ধরেন তারা সারা দিনে পান ৮-১০টি ইলিশ। এই ইলিশ নদীতেই কিনে আড়তে এনে বিক্রি করে একটি পক্ষ। এই মধ্যস্বত্বের মাছ নিয়ে চলে কোল্ডস্টোর আর বিভিন্ন এলাকায় মাছ পাঠানোর দাদন নেয়া ঘাটের আড়তদারদের কাড়াকাড়ি। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম, তাই বাড়ে ইলিশের দাম। তিনি জানান, ‘সেখানেও আছে বরফ, আড়ৎ ভাড়া, লাইসেন্স, চাঁদাবাজি, লেবার খরচের সাথে মুনাফার হিসাব। সাগর বা নদী থেকে আনা ইলিশ আড়তে বিক্রির ক্ষেত্রে সাধারণ খরচ দেখিয়ে মনপ্রতি ৪শ টাকা নেয় আড়ত মালিকরা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য আড়তে মাছ গেলেও একই নিয়ম। এভাবে প্রতি মনে বাড়ে আরও ৮শ টাকা। এর সঙ্গে আছে আড়তের লাভ। সব মিলিয়ে আকাশে ওঠে ইলিশের দাম।’
বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটা তো পুরোপুরি অনিশ্চয়তার ব্যবসা। তবে ইলিশ রফতানি না হলেও পাচার আছে। সাগর থেকে অসৎ জেলেরা ভারতীয় ট্রলারে কিছু মাছ পাচার করে নিজেদের দাদনের টাকা তুলে নিতে, কিংবা সাথে থাকা বরফের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকার কারণে। আবার ঘাটে আসা ইলিশ পাচার হয় সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিকরগাছা, বেনাপোল, ঝিনাইদহ, কালীগঞ্জ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়ার প্রাগপুরের আড়তে পাঠিয়ে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দাদনের টাকা পরিশোধের বাবদে এসব মোকামের আড়তদারদের অধিকাংশই স্থানীয় চোরাকারবারিদের মাধ্যমে ইলিশ পাচার করে বলে জানাগেছে। সীমান্ত পথে পাচারের সুবিধার ওপর নির্ভর করে এসব আড়ত থেকে প্রতিদিন দেশের প্রধান প্রধান ইলিশের ঘাটে পাঠানো চাহিদা ও দামের ওপরেই মূলত: পরদিনের বাজারদর উঠানামা করে। আর এর ওপর টিকে আছে ইলিশ ধরার ব্যবসা। নইলে বাজার পড়ে যেত। কেউ আর এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করতো না।’
ইলিশ কেন ভারতে পাচার হয়, কারা পাচার করেন, পাচার করে কী লাভ যেখানে দেশের ভেতরেই ইলিশের দাম বেশী? তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাপনের খরচ যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে কম, সেখানে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ পাচার করে ওখানে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা যাবে, এটা বাস্তবসম্মত নয়। তাহলে ভারতে ইলিশ কেন পাচার হয়? এর জবাব একটাই। টাকা এবং রুপির মধ্যে বিনিময় মূল্যের পার্থক্য থেকে আসা মুনাফা। ভারতের অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে ইলিশ নিয়ে যান নিজেদের সারা বছরের বাধা ক্রেতাদের আবদার মেটানোর তাগিদে। সেখানে এটা উৎসবের মাছ। আর সেক্ষেত্রে মূল্যে তাদের কোন বাঁধাধরা নিয়ম থাকে না।
মোট কথা- ইলিশের বিশাল বাজারের প্রধান যোগানদার জেলেদের একাংশ ট্রলার বানায়, জাল কেনে এজন্য তাদেরকে কোনো রকম ঋণ সুবিধা দেয় না কোনো ব্যাংক। ট্রলার-জালেও হয় না বীমা। অন্য অংশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে নদীতে মাছ ধরে। আর বিপনন ও বানিজ্যে আছে আরও চারটি স্তর। সীমান্ত চোরাকারবারিরাও হয়ে গেছে এই ব্যবসার অংশীজন। সব পর্যায়েই হয় মূল্য সংযোজন। শেষ প্রান্তে থাকা ভোক্তকে সব দায় মিটিয়ে স্বাদ পেতে হয় জাতীয় মাছ ইলিশের। আর বাংলাদেশে এটিই মনে হয় একমাত্র খাত যারা উল্লেখ করার মতো কোনো সুবিধা না পেয়েও টিকে আছে।