জীবনযুদ্ধে নির্মমভাবে হেরে যাওয়া এক তরুণের নাম তোফাজ্জল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ী বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার তালুকের চরদুয়ানী । তারা দুইভাই আর বাবা মাকে নিয়ে ভালোই চলছিলো তোফাজ্জলদের সংসার।
তোফাজ্জল খুবই মেধাবী একজন শিক্ষার্থী ছিলো। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পেরিয়ে যখন সে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে শুরু করলো। এক সময় তার জীবনেও প্রেম এসেছিলো কিন্তু প্রেমে সফল হতে পারেনি এই যুবক। হয়তো তার ভালোবাসাটা গভীর ছিলো যেকারণে প্রথম ধাক্কাটি সামাল দিতে না পেরে হতাশ তোফাজ্জল। এলোমেলো হয়ে গেছে তার সবকিছু। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বই খাতা কলম। অসহ্য অস্থিরতাকে সামাল দিতে না দিতেই ২০১১সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায় তার পিতা আবদুর রহমান, শোকে-দুঃখে ২০১৩সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার মমতাময়ী মা বিউটি বেগম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০২৩ সালে মারা যায় তোফাজ্জলের একমাত্র বড় ভাই এসআই নাসির উদ্দিন। আপন বলতে কেউ রইলো না তার। তবুও বেঁেচ থাকার জন্য কত আকুতি ছিলো তোফাজ্জলের। দু হাত তুলে প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ করেছে সে কিন্তু গত ১৮ সেপ্টেম্বর চুরির অপবাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকহীন কিছু শিক্ষার্থী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ট দেখে যতটুকু বোঝা যায় দরিদ্র ছিলো না তোফাজ্জল শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার ছিলো সে। মায়া মমতার অভাব ছিলো বলেই সব রেখে সে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থেকেছে। আর আমরা নামের মানুষ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি।
দু-মুঠো ভাত ছাড়া অন্য কোন চাহিদা ছিলো না তার। ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে দুটো হাত বাড়িয়ে দিতো তোফাজ্জল। চোর ছিলো না সে, অথচ চোরের অপবাদ দিয়ে তাকে নিশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। কোন মানুষ যদি অপরাধ করে তার জন্য প্রচলিত নিয়মে আইন আছে। তা না করে যে ঘৃন্যতম অধ্যায়ের সূচনা হলো এই কলংক কি করে মুছবে বাঙ্গালী জাতি।
একটা সময় ছিলো । যখন মোবাইল ছিলো না। এত এত যান্ত্রিক গাড়ী ছিলো না। তখন গরু, মহিষ আর ঘোড়ার গাড়ীর প্রচলন ছিলো। মানুষ প্রয়োজনে অনেক দূর দূরান্ত পায়ে হেঁেট চলাচল করতো। তখন মানুষের ভেতরে অনেক মায়া মমতা ছিলো। শুনেছি যখন কোন পথিক কারো বাড়ীতে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি চাইতো তখন সাথে দুধ, দই বা অন্যান্য কিছু খাবার দিতো। আর কালের বিবর্তনে আজ আমরা মায়া মমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। ভাবতেই পারছি না এত নির্মম ভাবে মানুষ হত্যা করা যায়?
শাস্তি দিয়ে মৃত্যুর বিষয়ে পশুর বেলায়ও নিষেধাজ্ঞা আছে পবিত্র ইসলাম ধর্মে। আর একটা জীবন্ত মানুষকে এত কষ্ট দিয়ে, কিভাবে মারতে পারলো এরা। এত নির্দয় কিভাবে হতে পারে মানুষ। নিচে একটি লাঠি তার উপর হাত। হাতের উপর আরেকটা লাঠি রেখে দুইদিকে দুইজনে লাঠির মাথায় পাড়া দিয়ে শাস্তি দিচ্ছে তখন আর চোখের পানি আটকিয়ে রাখা যায় নি। মনের ভেতর কষ্টের ঝড় বইছে। মনুষ্যত্ব হারিয়ে মানুষ কিভাবে এত নিচে নেমে গেলো। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ তোফাজ্জল। এতো দেখলেই বুঝা যায় অথচ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীদের চোখে একটুও ভাসলো না। তারা এত নির্দয় কিভাবে হলো। এত কষ্ট করে পিতামাতা বিশবিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠালো এটা দেখার জন্য নয়। মনকে মানাতেই পারছি না। মানুষ মানুষের জন্য অথচ এই কথাটি কোন মূল্যায়ন হয়নি এখানে। দেশের মানুষ তোফাজ্জলের জন্য কান্না করেছে। ঐ কথাটির যথাযথ প্রমাণ হয়েছে যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে । যার আল্লাহ আছে তার সব আছে। তোফাজ্জলের জানাযায় আপনজন নেই তাতে কি! ইমাম সাহেব নিজেই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং গ্রামবাসীর সামনে তার স্মৃতি চারণ করে বিবেকহীন দোষী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা শিক্ষিত হয়েছো কিন্তু মানুষ হও নাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বাবা মারা গেল, মা-ও মারা গেল। আমার কাছে বড় আশ্চর্য্য লাগছে তার মা আর বাবার জানাযা আমিই পড়িয়েছিলাম। কিন্তু তোফাজ্জলের জানাযা আমাকেই পড়াতে হবে সে কথা বুজি নাই। ভেবেছিলাম তোফাজ্জল আমার জানাযায় শরিক হবে।’ দেখুন এখানেও প্রমাণ হলো যার কেই নাই-তার সব আছে। যাইহোক যেকোন হত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়। অবশ্যই সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে আর শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় মানবিক মূল্যবোধ, দয়ামায়া এই বিষয়গুলো পর্যাপ্তভাবে পাঠ্যবইয়ে স্থান দেওয়ার সু-ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলে ডাক্তার হলো কিন্তু মানুষ হলো না। ইঞ্জিনিয়ার হলো কিন্তু মানুষ হলো না তাহলে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণ কোন ভাবেই সম্ভব নয়। মানবিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে এই দেশটাকে এগিয়ে নিতে হবে। যেখানে ধনী, দরিদ্র পাগল, অসহায় নারী, শিশু একই প্লার্টফর্মে দাঁিড়য়ে তাদের অধিকার ভাগ করে নেবে। আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর বাংলাদেশের যেখানে প্রতিটি মানুষ তার অধিকারের কথা বলতে পারবে।
পরিশেষে বলবো যারা এই নির্মম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদের আবশ্যিকভাবে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তির মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার এই বাজে মন্তব্যটি মুছে ফেলতে হবে। যে কারণে আইনের শাসন অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না হলে অপরাধ বেড়েই চলবে। কোন ভাবেই এই জঘন্য অপরাধগুলোকে আশ্রয় দেয়া যাবে না। কঠিন বিচারের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে এখন আর তখনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না সুতরাং আমরা চাই হত্যাকান্ডসহ প্রতিটি অন্যায়ের সঠিক বিচার হোক।