প্রকাশ: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:০৬ পিএম (ভিজিটর : ৪৪৯)
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমানে যত সংকট রয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এজন্য রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে উঠতে উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বা রিজার্ভ পরিস্থিতি ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চিত রিজার্ভের পরিমাণও কিছুটা বেড়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো অর্থের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশকে তারা হাত খুলে ঋণ সহায়তা দিতে চাইছে। এসব আশ্বাসের অর্থ ছাড়ের ওপর ভর করে বাড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রিজার্ভ। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, অনেক দিন ধরে চলমান ডলার-সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাওয়ার এই সময় দাতাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ দ্রুত ছাড় করাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি মিলত। রিজার্ভ বাড়ানো প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রিজার্ভ বাড়াতে আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আমরা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল আছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকেও রিজার্ভ সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। এসব আশ্বাসের অর্থ ছাড় হলে রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়বে। আর কমবে না। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইএসডিবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা এবং অর্থ উপদেষ্টার একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, চীন প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররাও অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২১০ কোটি মার্কিন ডলার পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে বর্তমানে আছে ২ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে এর পরিমাণ ২ হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি। এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ রেমিট্যান্স বেড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে ২০ কোটি ডলারের বেশি কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য রয়েছে স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার কেনা। এতে কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছেন গভর্নর। সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভাঙচুরসহ আন্দোলনে সহিংসতার কারণে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অবশ্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা হয়নি। তবে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা ডলার সংকট এখন আরো তীব্র হয়েছে। ফলে বিপর্যস্ত অর্থনীতির ক্ষত সারিয়ে চাঙ্গা করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের হালে হাওয়া দিয়েছে দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন। অনেক দিন থেকেই দেশে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ কম ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা মুখ ফিরিয়ে থাকা বাংলাদেশে বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছেন। ড. ইউনূস সরকারের ভাবমূর্তিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটা ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ, অনুদান ও এফডিআই আসার পথ তৈরি হয়েছে। এসবের ইতিবাচক একটা প্রভাব বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে পড়ছে। এর ফলে যেখানে জুলাই মাসের হিসাবে চলতি দেনা বাদ দিয়ে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ছিল ১৩ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার; সেখানে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহান্তেই দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এ বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। তারা বলছেন, বিগত সরকার দেশের আর্থিক খাতকে বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারে নামিয়ে এনেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রিজার্ভও কমে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেমে গেছে। সেই জায়গা থেকে আর্থিক খাতের সংস্কার এখন খুবই জরুরি। আর এই সংস্কারের জন্য দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তা দরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যা বর্তমান বাজারমূল্যে দেশি মুদ্রায় ২০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর প্রায় ৩২ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ এখনো ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিদেশি সহায়তা ব্যবহার না করতে না পারার হার ক্রমেই বাড়ছে। গত ৮ বছর আগে ২০১৬ সালে এই হার ছিল ২৯ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করতে পেরেছে ১২ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার। এছাড়া দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি বাতিল করেছে দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। বাকি ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে। যা বাংলাদেশ চাইলে ব্যবহার করতে পারে। ইআরডির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সমস্যা আছে; তেমনি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দাতাদের নানা শর্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয়গুলো বিদেশি সহায়তার প্রকল্পে কম আগ্রহ দেখান। তবে কয়েক বছর ধরে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় কয়েক গুণ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, এই ঋণগুলো না নিয়ে সরকারের কোনো উপায় ছিল না। কারণ এটি ছাড়া রিজার্ভের পতন থামানোর আর কোনো উপায় ছিল না। শুধু তাই নয়, দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এখান থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ফলে এই ঋণগুলো পাওয়া গেলে ব্যাংকিং খাত একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আসবে। সেইসঙ্গে রিজার্ভ বাড়বে এবং ডলারের দামও স্থিতিশীল হবে। এভাবেই দেশের পুরো অর্থনীতি একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আসবে।