সন্তান কি করছে, কার সঙ্গে মিশছে এসব অনেক খবরই রাখছেন না অভিভাবকরা। রাজধানীর মিরপুর করেছে একাদশে ভর্তি হওয়ার এক কিশোর পুরো বছর মিরপুর বড় বাজার সংলগ্ন কাউন্দিয়া এলাকার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ক্লাশের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বছর শেষ জানা গেল মাত্র দু/চার দিন ক্লাশে অংশ নেয় সে। বাকী দিনগুলোতে কোথায় ছিল, কি করলো তার কোনো তথ্য নেই অভিভাবকের কাছে। ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও বাড়িওয়ালার ছেলে হওয়ার লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে তার আর্থিক কোনো সঙ্কট ছিল না। কিন্তু অভিভাবকের অসতর্কতার কারণে ইন্টারমিিিডয়েট পাশ করা হলো না এই কিশোরের। এই কিশোরের মতো আরও অনেক কিশোর রয়েছে যাদের অভিভাবকদের অমনোযোগিতার কারণে তারা নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন।
সারাদেশে কিশোর-কিশোরী অপরাধ বেড়েই চলেছে। কলেজের প্রবণতা এখন ধরা দিয়েছে স্কুলগুলোতেও। বিশেষ করে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষাথীর্রা জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক কমর্কাণ্ড। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাসী এমন কি হত্যা করার মতো জঘন্য কমের্ কতিপয় কিছু কিশোর লিপ্ত। প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজগুলোতে কিশোর অপরাধের খবর দেখতে পাই। নতুন করে মাদকে আসক্তি ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে উঠতি বয়সী কিশোরদের মাঝে। অবৈধ সম্পকের্ জড়িয়ে পড়া, যৌন হয়রানিসহ নারী সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোতেও কিশোরদের ভ‚মিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘সঙ্গ দোষে রঙ্গ মেলে’। সৎ সঙ্গে স্বগর্বাস, অসৎ সঙ্গে সবর্নাশ। সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে অনেক ভদ্র কিশোরও জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক কাজে। কিন্তু কেন? কোনো কারণে তারা এ পথ বেছে নিচ্ছে?
পরিসংখ্যান বলছে প্রেম ঘটিত কাহিনী, খারাপ সহপাঠীদের সঙ্গে মেশা, অথৈর্নতিক চাপ এবং দুঃশ্চিন্তা আর হতাশার কারণেই কিশোর অপরাধ বেড়ে চলছে। অভিভাবকদের উদাসীনতা এতে বড় প্রভাব ফেলেছে। সন্তান কী করে, কোথায় যায়, বাসায় কখন ফিরে এসব খবর নেয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের অসচেতনতা ও মূল কারণ।
আবার কিছু কিছু অভিভাবক সন্তানকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেও ঠকছেন। সমবয়সীদের প্রেমের কারণে মনস্তিক ভাবেও ভেঙে পড়ছেন কিশোর-কিশোরীরা। প্রেমে ব্যথর্ হয়ে অনেকই অনৈতিক পথ বেছে নেন।
এইতো কয়েক বছর আগের কথা পুলিশকন্যা ঐশির কথা নিশ্চই আপনাদের মনে আছে। যখন যা চাইতো সন্তান তখনই তা দিতো। শুধু সন্তান কোথায়, কখন যেতো সে খবর রাখেনি বলেই হয়তো সন্তানের কাছেই জীবন বিসজর্ন দিতে হয়েছে। শুধু কি তাই? এমন অনেক ঘটনা নিত্যনতুন জন্ম হচ্ছে। পদার্র অন্তরালে সমবয়সী শিক্ষাথীর্রা জড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ অন্ধকারের পথে। আলো খুঁজতে গিয়ে যেন অন্ধকারে পথভ্রষ্ট হচ্ছে তারা।
২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে নতুন মডেলের মোটরসাইকেল না পেয়ে ১৭ বছরের কিশোর ছেলে তার বাবা ও মায়ের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মা বেঁচে গেলেও বাবা এ টি এম রফিকুল হুদা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দেশের আনাচে-কানাচে এমন অনেক কিশোরই আছেন যারা কিশোর অপরাধের সঙ্গে হরহামেশা যুক্ত হচ্ছে। ধষর্ণ, হামলা, মাদক সেবন এমন কি বø্যাক মেইলের মতো ঘটনা তারা ঘটাচ্ছে।
পরিবারের যেমন মাথা নিচু হচ্ছে তেমনি তাদের ও সাহস বাড়ছে। কেননা আইনের মারপ্যাঁচে এরা পড়লেও আবার ঠিকই কোনো না কোনোভাবে আইনের ফাঁদ থেকে এরা বেরিয়ে আসছে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কিশোর অপরাধে পরিবারের উদাসীনতাই মূল কারণ। সন্তান কী করছে না করছে, সে কথা কজন অভিভাবকই বা রাখেন! প্রশ্ন হচ্ছে ঐসব কিশোর কি অভিভাবকদের কথা মতো চলে?
না, বেশিরভাগ কিশোরাই অভিভাবকদের কাছে তাদের জীবনের অনেক কথাই গোপন রাখেন। সন্তান কি করছে এটা নিয়েও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে উঠতি বয়সি কিশোরদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূণর্ আচরণ গড়ে না ওঠার কারণেই অভিভাবকরা জানতে পারছেন না তার সন্তান কী করছে? কোথায় যাচ্ছে? কাদের সঙ্গে মিশছে?
তবে হতাশার কথা হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা ভুল পথে হাঁটলেও অভিভাবকরা তেমন কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। যদি সন্তান আত্মহত্যা করে বসে সে চিন্তা থেকেই অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে ডাকও দিতে পারছে না।
আবার অন্ধবিশ্বাসী অভিভাবককে বেশির ভাগ কিশোর-কিশোরীই ধোঁকা দিচ্ছে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনে যেমন আশীবার্দ বহন করছে ঠিক তেমনি অভিশাপ ও বহন করছে। প্রযুক্তির বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে কিশোর-কিশোরীরা অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রেমের পথে পা বাড়াচ্ছে। একটা সময় মনকে সামলে রাখতে না পেরে হুট-হাট চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে ধ্বংসের দিকে ও হেলে পড়ছে তারা। আর এ কাজে সহায়তা করছে কাছেরই কোনো বন্ধু-বান্ধব।
নতুন তথ্য হচ্ছে একজন সুস্থ মনের, মেধাবী কিশোরিকে ভুল বুঝিয়ে অন্ধকার পথে ঠেলে দেয়ার কাজটি করে যাচ্ছে তারই কোনো কাছের বন্ধু। এমনকি নিজে বাতার্ বাহকের কাজটিও করছে সে। এদিকে কিশোরীর অবুঝ মনকে পুঁজি করে ছোটখাটো বø্যাক মেইলের পথ ও বেছে নিচ্ছে কোনো কোনো কাছের বন্ধু। বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো, ঐ বন্ধু নামের কিশোরীও লোভে পড়ে এমন কাজটি করছে। এরা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠছে যে, এদের মধ্যে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেতেও শুরু করেছে। যখন-তখন বাজে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনি যদি আশপাশে তাকান তবে দেখবেন পাকর্গুলোতে কলেজ এবং স্কুলপড়ুয়া জুটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক’দিন আগে বিভিন্ন পাকর্ থেকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া জুটিকে গ্রেফতার করতে দেখা গেছে পুলিশ প্রশাসনকে।
কিছুদিন আগে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে তাসফিয়া নামের এক কিশোরীর মৃত দেহ পেয়েছে পুলিশ। জানা যায় সে সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। অনেকেই ধারণা করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেমের সম্পকর্ গড়ে ওঠে এবং এক পযার্য় হয়তো তাকে সে ফেসবুকের প্রেমিকের দ্বারাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে।
শুধু যে কিশোর-কিশোরীদের মান সম্মান বিনষ্ট হচ্ছে এমন নয়। তাদের কমর্কাÐে গোটা পরিবারের মাঝেই অশান্তির ছায়া নেমে আসে। তাই সব অভিভাবকের উচিত সন্তান কি করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কোনপথে অথর্ বিনষ্ট করছে, আচার-আচরণ সব দিক বিবেচনা করে বন্ধুত্বপূণর্ সম্পকের্ গড়ে তোলা। ভবিষৎ প্রজন্মকে অন্ধকারের হাত থেকে বাঁচাতে হলে প্রথমে অভিভাবকদেরই সচেতন হওয়া জরুরি। সব সময় সন্তানের পক্ষে সাফাই না গেয়ে দোষ-ত্রæটিগুলো সংশোধনের ও সুযোগ দেয়া উচিত। প্রজন্ম সুন্দর পথে এগিয়ে যাক প্রত্যাশা।
লেখক : হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট