*বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে পাঁচ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর
*জাতিসংঘে নারী মহাসচিব নিয়োগের মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা আনার দাবি
*বিবিএনজেতে চুক্তি স্বাক্ষর
বিশ্বকে অজানা হুমকির হাত থেকে বাঁচাতে এবং প্রাকৃতিক সুরক্ষায় বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিলে ‘সমানভাবে’ অর্থ বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি প্রধান এই অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার ‘জলবায়ু ন্যায্যতা প্রদান: ত্বরান্বিত উচ্চাকাঙ্খা এবং অভিযোজন ও সবার জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এক অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী এ পরামর্শ দেন।
জলবায়ু উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই সামিটে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসন্ন সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা আশা করি বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং আসন্ন সংকট এড়াতে তাদের ন্যায্য অংশীদারত্বের বিষয়ে স্বচ্ছ ও সৎ থাকবে। সভায় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দু’টি উদ্যোগ এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এর মধ্যে ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম ফর অল’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো- ২০২৫ সালের মধ্যে সবার জন্য আগাম সতর্কতা নিশ্চিতকরণ। এই উদ্যোগের অধীনে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য জাতিসংঘ প্রথম যে ৩০ টি দেশকে বাছাই করে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
গতকাল বুধবার ছিল জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনের তৃতীয় দিন। এদিন সম্মেলনে জলবায়ু উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে একটি সামিট অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সম্মেলনের ফাঁকে এদিন উচ্চ পর্যায়ের আরও কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জলবায়ু উচ্চাকাঙ্খা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে অংশ নেয়া অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বলেন, জলবায়ুর ন্যায্য অংশীদারীত্বের বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে বরবরাই প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে জলবায়ু তহবিলে শীর্ষ ধনী দেশগুলোর সমান অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তারা।
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে পাঁচ প্রস্তাব :
এদিকে উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা শীর্ষক ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি হতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলো ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়”। কোভিড অতিমারি প্রমাণ করেছে যে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে যেকোন সংকট থেকে পুনরুদ্ধার সম্ভব। আমরা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বসূচকে পঞ্চম স্থান লাভ করেছি। এসময় তিনি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতে যেকোন স্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘের কাছে পাঁচটি প্রস্তাব করেন।
প্রস্তাবগুলো হলো- উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সহজলভ্য অর্থায়ন; বিজ্ঞান-ভিত্তিক পদ্ধতিতে অতিমারি নজরদারি, প্রতিরোধ, প্রস্তুতি সংস্থান ইত্যাদি।
এর আগে জাতিসংঘ সদর দফতরের দ্বিপাক্ষিক বুথে মা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য অংশীদারিত্বের (পিএমএনসিএইচ) চেয়ার হেলেন ক্লার্কের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন প্রধানমন্ত্রী।
এসময় শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকটের কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ শতকরা ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে যা আমাদের এ খাতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের যে প্রচেষ্টা তারই প্রতিফলন।
জাতিসংঘে নারী মহাসচিব নিয়োগের দাবি:
এদিন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রতিনিধি ডাইনিং রুমে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ইউএনজিএ প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডারদের বার্ষিক সভায় বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। এসময় তিনি জাতিসংঘে নারী মহাসচিব নিয়োগের মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা আনার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীদের জীবনে ইতিবাচক সিদ্বান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে তাদের অবশ্যই নেতৃত্বের অবস্থানে থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের কর্মকান্ডকে অংশগ্রহণ থেকে নেতৃত্বে উন্নীত করতে হবে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অবশ্যই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এটা দুঃখজনক যে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সময় এসেছে, আমরা শিগগিরই একজনকে পাবো।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অবশ্যই নিজেদের অংশীদারিত্বের ভিত্তি বাড়াতে হবে যাতে সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা একটি আদর্শ হয়ে ওঠে। নারীর অংশগ্রহণকে উচ্চতর পর্যায়ে এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। নেতা হিসাবে, আমাদের তাদের সাথে জড়িত থাকতে হবে এবং তাদের এই বিষয়ে সাহসী উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করতে হবে।
অধিবেশনের তৃতীয় দিন বুধবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আরেকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানানো হয়। একই সাথে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মায়ানমারে প্রত্যাবাসনের নিশ্চিত করতে দেশটির উপর চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়।
বিবিএনজে’তে স্বাক্ষর:
এদিকে অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততা সম্পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বুধবার সন্ধ্যায় জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিক মাছ ধরা এবং অন্যান্য মানবিক কর্মকা-ের কারণে ভঙ্গুর সামুদ্রিক পরিবেশের ক্ষতির হাত থেকে বিশ্বের মহাসাগর এবং নদীগুলোকে রক্ষায় মেরিন বায়োডাইভারসিটি অব এরিয়াজ বিয়ন্ড ন্যাশনাল জুরিসডিকশন (বিবিএনজে) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। জেনারেল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং এর ট্রিটি ইভেন্ট এলাকার গ্রাউন্ড ফ্লোরে বুধবার ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য সি’র অধীনে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
চুক্তিতে সাধারণ ঐতিহ্য হিসাবে বর্ণিত জেনেটিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান এবং নেদারল্যান্ডের বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী লিজে শ্রেইনেমাচারের সাথে কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগদানের পাশাপাশি জলবায়ু গতিশীলতার ওপর প্রাতঃরাশ শীর্ষ সম্মেলন এবং ১৮ তম এশিয়া সহযোগিতা সংলাপসহ বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন।
মোমেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ বাকি দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ধনী দেশগুলো মূলত কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী । এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবদান মাত্র ০.৪৭ শতাংশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধনী দেশগুলোকে প্রতি বছর জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি মেনে চলার আহ্বান জানান।
এরআগে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আরেকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন। এসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান।
একই সাথে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মায়ানমারে প্রত্যাবাসনের নিশ্চিত করতে দেশটির উপর চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দিনভর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) বিষয়ভিত্তিক রাষ্ট্রদূত সায়মা ওয়াজেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিলেন।