দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট থাকলেও চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম। ফলে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো। যে জন্য গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুতের লোডশেডিং অস্বাভাবিক বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দিনে দুই-তিনবার করে লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও কোথাও তারও বেশি। ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও হঠাৎ করে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সামিটের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল বন্ধের কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে ১২০০ মেগাওয়াটের মতো কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে বকেয়ার কারণে ভারতের আদানি গ্রুপ প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছে। এর সঙ্গে কারিগরি কারণে বড়পুকুরিয়া কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং মাতারবাড়ী ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়েছে কয়েক দিন ধরে।
বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার চেষ্টা করছে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে। এ জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি, কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।
জানা গেছে, গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি এখন রাজধানী ঢাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। গত মাসের শেষদিক থেকে রাজধানীতে অল্পস্বল্প লোডশেডিং শুরু হলেও এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের অভাবে কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া তেলভিত্তিক অনেক কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে। এ কারণে লোডশেডিং ক্রমে বাড়ছে। অন্যদিকে, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে না পারার বিষয়ে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, সামিটের এলএনজি টার্মিনাল (ফ্লোটিং স্টোরেজ এবং রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট-এফএসআরইউ)) বন্ধ থাকায় গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। যে কারণে সব খাতেই গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। সাগরের সৃষ্ট নিম্নচাপ কেটে গেলেই বন্ধ এলএনজি টার্মিনালটি চালু করা হবে।
রাজধানীসহ সারা দেশে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, গ্যাসের অভাবে এখন ১২শ থেকে ১৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। বিশেষ করে সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি চালু না হওয়ায় সংকট প্রকট হয়েছে। তিন মাস ১০ দিন ধরে বন্ধ এফএসআরইউটি। এ ছাড়া তেলভিত্তিক অনেক কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে। ফলে লোডশেডিং বেড়েছে। গরমের কারণে গ্রাহকদের কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, তার পরও আমরা চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন বাড়াতে।
সামিটের এলএনজি টার্মিনাল চালু এবং গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, সামিটের এফএসআরইউর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষ। কিন্তু সাগরে নিম্নচাপ থাকায় এটি চালু করা যাচ্ছে না। সাগরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টার্মিনালটি চালু করা যাবে। তবে টার্মিনালটি চালু হলেও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে না পারায় পাঁচ-ছয় দিন সীমিত আকারে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। তিনি জানান, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির আগ পর্যন্ত ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরেই তারা লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন, আর গত ৩-৪ দিন ধরে এটি চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। গত কয়েকদিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই এবং গাজীপুরের বাসিন্দারা। অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলোতে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সূত্র বলছে, এই অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। পল্লী বিদ্যুৎ-১-এর সূত্র জানায়, বিদ্যুতের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম থাকায় তারা দিনে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছেন না। ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক মোল্লা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ৩১৩ মেগাওয়াট, কিন্তু সরবরাহ মাত্র ১৭০ মেগাওয়াট। এ সমিতির আওতায় শিল্প ও আবাসিক মিলিয়ে পাঁচ লাখেরও বেশি গ্রাহক রয়েছেন। অন্যদিকে, ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মাশফিকুল হাসান বলেন, তাদের চাহিদা ৪২৫ মেগাওয়াট, বিপরীতে সরবরাহ মাত্র ৩০৬ মেগাওয়াট।
পিডিবির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৩৩ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ মেগাওয়াট। আর লোডশেডিং করা হয়েছে ১ হাজার ৭৬৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বিভাগভিত্তিক সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে ময়মনসিংহে ২৫৭ মেগাওয়াট। এ ছাড়া ঢাকায় ২২৫ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ১৪৭ মেগাওয়াট, কুমিল্লায় ২১৭ মেগাওয়াট, সিলেটে ১০৫ মেগাওয়াট এবং রংপুরে ১২৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালে কোনো লোডশেডিং হয়নি। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, লোডশেডিংয়ের যে হিসাব করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে।