মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলছে উত্তপ্ত সংঘাত। সেই সংঘাতের আতঙ্ক এবার ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ টেকনাফ সীমান্তে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা নৌকায় চড়ে টেকনাফ সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে। সীমান্তের নানা পয়েন্টে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নানা সতর্কতার পরও অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সুযোগ নিচ্ছে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র।
সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, সরকার পতনের পরপর কয়েকদিন সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন তৎপরতা ছিল না। মূলত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা শুরু করে। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেননি। কূটনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনার পরও সংকট সমাধানে কোনো অগ্রগতি নেই। এই সমস্যায় আবার যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। আবারও সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকেছেন রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বেড়েছে। ফলে নতুন করে আরও ১৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্তে অবস্থান করছে।
সরকারি একটি দায়িত্বশীল সংস্থার তথ্য বলছে, টেকনাফ ও উখিয়ার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ৯৭৫ জন রোহিঙ্গার নতুন করে অনুপ্রবেশের তথ্য পেয়েছেন। সেই সব রোহিঙ্গা নানাভাবে ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ির পাশাপাশি অনেকে ভাড়াবাসায় অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রাতে টেকনাফের নাফ নদ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেখেছেন। এসব রোহিঙ্গা যাতে স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে অবস্থান নিতে না পারে; তার জন্য এলাকাবাসীকে সতর্ক করা হয়েছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত সাত-আট দিনে ১৪ হাজার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মংডু সীমান্তে জড়ো হয়েছে আরও ৬০-৭০ হাজার রোহিঙ্গা। নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গাদের অধিকার সংগঠন আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা-সংকটের গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে নতুন করে আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনী লড়াইয়ে রোহিঙ্গারা নির্মূল হচ্ছে। লড়াই বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর হস্তক্ষেপ দরকার।
সূত্র আরও জানায়, কয়েক দিন ধরে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের চলমান যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে। মংডু টাউনে থাকা সেনা ও বিজিপির দুটি ব্যারাক (ব্যাটালিয়ন) দখলের জন্য মরিয়া আরাকান আর্মি। গোলাগুলির পাশাপাশি দুই পক্ষ থেকে ছোড়া হচ্ছে মর্টার শেল, গ্রেনেড-বোমা। মাঝেমধ্যে ড্রোন হামলাও চালানো হচ্ছে। মংডু টাউনের পাশে লাগোয়া পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, উকিলপাড়া, নুরুল্লাপাড়া দখল করে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। মংডুসহ আশপাশের রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।
জানা যায়, টেকনাফের নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-২৪) ঠাঁই নিয়েছে মংডু থেকে পালিয়ে আসা কয়েক শ রোহিঙ্গা। পাশের জাদিমুরা, মুছনীসহ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরেও ঠাঁই নিয়েছে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা। বেশির ভাগই নারী এ শিশু। দলের একজন হাকিম আলী (৫১) বলেন, গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে নৌকায় নাফ নদী অতিক্রম করে তিনি এই আশ্রয়শিবিরে ঢুকেছেন। সঙ্গে স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। ওঠেন এক আত্মীয়ের ঘরে। গাদাগাদি করে থাকছেন সবাই। নাফ নদী পারাপারে টেকনাফের দালালদের দিতে হয়েছে মাথাপিছু পাঁচ লাখ কিয়েত (মিয়ানমারের মুদ্রা, ১৮ কিয়েতে ১ টাকা)। এক নৌকায় ১০-১২ জন আসা যায়। রেহেনা বেগম (৪৫) নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, মংডুতে জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। মর্টার শেলের আঘাতে তাঁর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। স্বামীও নিখোঁজ। তিন সন্তান নিয়ে তিনি পাঁচ দিন আগে টেকনাফে পালিয়ে আসেন। তারপর ওই আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেন। তাদের মাথাপিছু পাঁচ লাখ কিয়েত করে দিতে হয়েছে। নয়াপাড়ার আশ্রয়শিবিরের ই-ব্লকের অন্তত ৩৪টি ঘরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছে জানিয়ে ওই ব্লকের রোহিঙ্গা নেতা নুরুল আলম বলেন, কমবেশি সব রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরে পৌঁছায়। মংডুর পশ্চিমে চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদীর এপারে টেকনাফ উপজেলা। উখিয়ার লম্বাশিয়া, কুতুপালং, বালুখালী আশ্রয়শিবিরেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে।
টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে এখন পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ হাজার রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছেন জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবিরগুলোতে থাকা আত্মীয়-স্বজনের (পুরোনো রোহিঙ্গা) ঘরে আছেন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ও আহত রোহিঙ্গাও আছেন। তাদের আশ্রয়শিবিরে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, নাফ নদী ও সীমান্তে কড়াকড়ির পরও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ স্থানীয় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে এখনো পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে। তারাও যদি বাংলাদেশে চলে আসে, তাহলে নতুন সংকট দেখা দেবে। যেকোনো মূল্যে অনুপ্রবেশ ঠেকানো দরকার।
নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশের বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেছেন, আমরা স্পষ্ট করেই বলেছি, আর একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দিতে রাজি নই। কিন্তু কিছু ঢুকে যাচ্ছে, এটা আমরা জানি। সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করছি। বিজিবি প্রতিদিনই ফেরত পাঠাচ্ছে যাদের আমরা ধরতে পারছি। কিন্তু একটা বড় এলাকা নিয়ে তারা ঢুকছে। সবাইকে যে আমরা ধরতে পারছি তা নয়, সামর্থ্যেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যেখানে পারছি ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, ইউএনএইচসিআর চায় আমরা তাদের আশ্রয় দিই। কিন্তু আমরা তাদের কাছে স্পষ্ট করেছি- আমরা যে ১৪ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের যেটুকু ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন তারচেয়ে বেশি পালন করেছি। যারা আমাদের উপদেশ দিতে চায় তারা বরং তাদের নিয়ে যাক। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখল করার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।