শিক্ষার মানের উন্নতির প্রথম শর্ত ‘দক্ষ শিক্ষক’। যেকোনো পর্যায়ের শিক্ষকতার চেয়ে প্রাথমিকে শিক্ষকতা কঠিন। স্পর্শকাতর ও কোমলমতি শিশুদের মন-মর্জি বুঝে পাঠদান দিতে হয় শিক্ষকদের। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান খুবই দুর্বল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বলে আসছে জাতিসংঘ শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। সংস্থাটি তাদের গবেষণায় বলছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা দিতে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের ওপর জোর দিয়ে আসছেন শিক্ষাবিদেরা। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ বা ডিপ্লোমা কোর্স নিয়ে খোদ প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন উল্টোনীতিতে হাঁটছে। শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী দেড় বছরের ডিপিএড কোর্স নিয়ে আবারও নতুন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। একের পর এক মনগড়া আর উদ্ভট সিদ্ধান্তের উদ্যোগে নিলে এটি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ ও শিক্ষাবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী, দেশের পিটিআইগুলোতে ১৮ মাসের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছিল। গত বছরের ২৮ আগস্ট একে সংক্ষিপ্ত করে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই বছর ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড)’ কোর্সের নামই পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। তখন এর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘মৌলিক প্রশিক্ষণ’। এক বছরের মাথায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে চাইছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। এবার এই প্রশিক্ষণ কোর্স ৬ মাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পিটিআইকে ‘ছুটিহীন’ (নন-ভেকেশন) প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিপিই মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত ওই চিঠি গত ২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। ডিপিই’র এই প্রস্তাবনাটি অনুমোদন দিতে ইতিমধ্যে তোড়জোড় শুরু করেছে মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতনরা। অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করে শুধুমাত্র দু-চারজন আমলার কল-কাঠিতে এই কোর্সকে অতি সংক্ষিপ্ত করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে অভিযোগ করেছেন শিক্ষাবিদরাসহ সংশ্লিষ্টরা।
প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদ অতি সংক্ষিপ্ত করার যৌক্তিকতা বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিই’র পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো: ইমামুল ইসলাম ভোরের ডাককে বলেন, এটি প্রাথমিক প্রস্তাব। এ সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্তগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদ কমানোর চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে মন্ত্রণালয়।
গত ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং বলে খ্যাত পরিমার্জিত ডিপিএড (বিটিপিটি) মৌলিক কোর্সের মেয়াদ কমানো নিয়ে গত ১৫ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যপত্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরিমার্জিত ডিপিএড (বিটিপিটি) একটি মৌলিক প্রশিক্ষণ বিধায় কোর্সের মেয়াদ ১০ মাসের পরিবর্তে ৬ মাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাতে কার্যত পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ হবে ৪ মাস ১৫দিন। আর বাকি ১ মাস ১৫দিন হবে বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ। প্রস্তাবিত ৬ মাস মেয়াদের বিটিপিটি প্রশিক্ষণ চলমান জুলাই ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ সেশন থেকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অর্থ্যাৎ যেসব শিক্ষকরা গত জুলাই থেকে পিটিআই ট্রেনিং যুক্ত হয়েছেন, তাদের ট্রেনিং সময়কাল নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যকর হবে। গত জুলাইয়ের সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, চলমান বিটিপিটি প্রশিক্ষণের কোনো অধিবেশন বিয়োজনের প্রয়োজন নেই। আর বিপিটিপি কোর্সের প্রস্তাবিত মেয়াদ ৬ মাস চ‚ড়ান্ত অনুমোদিত হলে প্রশিক্ষণ বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। একই সঙ্গে পিটিআইকে নন-ভেকেশন (ছুটিহীন) প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রস্তাব/সুপারিশ পাঠাতে হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা ভোরের ডাককে বলেন, ডিপিইর এ সিদ্ধান্তের একটি চিঠি আমাদের কাছে এসেছে। আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে কার্যক্রম শুরু করেছি। তাহলে পরিমার্জিত ডিপিএড/বিটিপিটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদ ১০ মাসের পরিবর্তে ৬ মাস হবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্টা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কোর্স সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) সাবেক মহাপরিচালক মো: শাহ আলম কে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পরামর্শক শাহ আলম প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত একটি মনিটরিং প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। দাখিলকৃত মনিটরিং প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও বিটিপিটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে মতামত/সুপারিশ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয় ডিপিই। বিটিপিটি পরামর্শক কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদন ও দাখিলকৃত মনিটরিং প্রতিবেদনের আলোকে ডিপিই’র অনুষ্ঠিত সভার কার্যপত্রসহ একটি চিঠি মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ এর বক্তব্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। যদিও তিনি ভোরের ডাককে বলেন, বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কোর্স নিয়ে আমরা একজন পরামর্শ নিয়োগ দিয়েছি। তার সুপারিশমতে আমরা প্রশিক্ষণ মডিউল সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। প্রশিক্ষণে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হবে, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করার কথা ভাবছি। তবে প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, টেনিউর (প্রশিক্ষণ সময়কাল) একদিন কমানো হবে না, বাড়ানো হবে না।
শিক্ষক, শিক্ষাবিদরা যা বলছেন
শিক্ষকদের পিটিআই প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল অতি সংক্ষিপ্ত করার ফলে মান নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এটি একটি গোজামিল ট্রেনিং ছাড়া আর কিছুই হবে না। ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে অপেক্ষমান শিক্ষকদের তড়িগড়ি করে ট্রেনিং দেওয়ার নামে শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী, এ ট্রেনিং শিক্ষকদের জন্য একটি ডিপ্লোমা কোর্স। এতে ১০ মাস যেমন সঠিক হয়নি, তেমনটি সেটি অতিসংক্ষিপ্ত করে ৬ মাস করা হবে আরও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
সংক্ষিপ্ত পরিসরের কোর্সের মান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি গতকাল ভোরের ডাককে বলেন, প্রাথমিকে পিটিআই শিক্ষক ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। মন্ত্রণালয় কি চাইছে, অতি সংক্ষিপ্ত কোর্সের মাধ্যমে অপেক্ষমান থাকা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দ্রæত শেষ করতে, নাকি মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে। যদি উদ্দেশ্য হয় যে, ক্র্যাশ প্রেগ্রাম করে দ্রæত ট্রেনিং শেষ করতে হবে, তাহলে অযথা রাষ্ট্রের টাকার অপচয় করার কোনো মানে হয় না। তিনি আরও বলেন, এক বছরে ভালো কোনো প্রশিক্ষণ হবে না বলেই শিক্ষানীতির সুপারিশে সেটা দেড় বছর করা হয়েছিল। কারণ, এটি একটি ডিপ্লোমা কোর্সের মতো। আবার যদি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নাম দেওয়া ‘মৌলিক প্রশিক্ষণ’Ñ সেটাও এই ১০ মাস বা ৬ মাসে মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এভাবে মন্ত্রণালয়ে দু-চারজন আমলা বসে একটা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আর সেটা বাস্তবায়ন করে ফেললামÑ এটা হাস্যকর। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিপিএড বা নতুন বিটিপিটি কোর্সের কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটি পরিমার্জন করে আরও উন্নয়ন করা যেতে পারে। কিন্তু তা না করে প্রাথমিকের শিক্ষা প্রশাসন উল্টো পথে যাচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম ভোরের ডাককে বলেন, এই কোর্সের মাধ্যমে নতুন একজন শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। গতবার ১৮ মাস থেকে ১০ মাস করায় এমনেতেই ক্ষতি হয়েছে, এখন সেটা ৬ মাসেÑ এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়।
জানা যায়, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণ কোর্সকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে কোর্সটির মেয়াদকাল করা হয় ১০ মাস। এর মধ্যে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) ৬ মাসের সরাসরি প্রশিক্ষণ এবং বিদ্যালয়ে ৪ মাসের প্র্যাকটিস টিচিং প্রোগ্রাম থাকবে। এভাবেই চলতি বছরের সেশন থেকে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে ওই বছর কোর্সটির নাম পরিবর্তন করে ‘প্রাথমিক শিক্ষক মৌলিক প্রশিক্ষণ’ করা হয়। এর আগে এ কোর্সটির মেয়াদ ছিল ১৮ মাস। এখন এই কোর্স ৬ মাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৪ লাখ ২৭ হাজার ৯৭১টি। এখন কর্মরত আছেন ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৫ জন শিক্ষক। তাদের মধ্যে স¤প্রতি নিয়োগ পাওয়া অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষকও আছেন। তারাসহ প্রায় পৌনে এক লাখ শিক্ষক বর্তমানে প্রশিক্ষণবিহীন বলে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
জানা যায়, স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য এক বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন (সিইনএড) চালু ছিল। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী সিইনএডকে আরও যুগোপযোগী করে ১৮ মাস মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্সের প্রবর্তন করা হয়। পরে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে শিক্ষানীতির সুপারিশ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২০১২ সালে প্রথমে সাতটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বছর মেয়াদি কোর্স চালু করা হয়। গুরুত্ব বিবেচনা করে এই কোর্সের নাম দেওয়া হয় ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন’। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সাল থেকে দেশের সবকটি পিটিআইয়ে এই কোর্স শুরু করা হয়।
আরও জানা যায়, বর্তমানে দেশের ৬৭টি পিটিআইয়ের অধীনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এটি সব শিক্ষকের জন্যই বাধ্যতামূলক। পিটিআইগুলোর এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটির কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করছে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)।