রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদলের সাথে সাথে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্থিরতা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল-কলেজের শিক্ষক এবং অন্যান্য পদাধিকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে উপাচার্য, অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাধারণ শিক্ষকও। এমনকি পরিচালনা পর্ষদ পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এজন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লেকচার অপছন্দ হলে তা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই, কাউকে কোনো কোর্সের জন্য উপযুক্ত মনে না হলে সেটা জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই, শিক্ষক নিয়োগে নেই কোনো স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ডের প্রতিফলন। ছাত্রাবাসের মান উন্নয়ন নিয়ে কেউ ভাবে না, খাবারের মান বাড়ানোর চিন্তা নেই কারও। হলগুলোকে রীতিমতো বর্গা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কাছে। এসব নিয়ে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের ক্ষোভ দিনে দিনে পুঞ্জিভূত হয়েছে।
সিলেবাস নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে কি না, পরীক্ষা ও ফলাফল এক বছরের মধ্যেই হচ্ছে কি না, তা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই কোনো তদারকি। ছাত্রাবাসগুলোয় থাকতে দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে ছাত্রদের ব্যাপারে এমনটাই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্রদের মনোভাব। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এসব নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ে ছাত্রদের দীর্ঘদিনের ক্ষাভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এভাবে।
কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যন্ত শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা কার্যত: অনেকটাই সংক্রামক হয়ে উঠেছে। সেখানের সমস্যা ভিন্ন। প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব বিস্তার, যোগ্যতার অভাবে নিয়োগ বঞ্চিত, পদোন্নতিকাঙ্খী শিক্ষকদের ক্ষোভ, শিক্ষকদের দল-উপদলের কোন্দলের সাথে প্রাইভেট পড়ানোর বাজার দখলের বিভিন্ন স্বার্থের দ্ব›দ্বই এসব ক্ষেত্রে মূখ্য। প্রতিষ্ঠাতার অবদান, স্থানীয় শিক্ষানুরাগির নিরলস শ্রমের সাফল্য, প্রবীন শিক্ষকের দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও শ্রম, প্রতিষ্ঠানের মান অর্জনে কঠোর অনুশাসনের ভ’মিকা কোন বিবেচনায় আসছে না।
ঢালাও দুর্নীতির তকমা লাগিয়ে দিয়ে ব্যাক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে এসব ক্ষেত্রে কোমলমতি ছাত্রদের ব্যবহার করছে স্বার্থান্বেষীরা। নেপথ্যের উষ্কানি এমন পর্যয়ে পৌঁছেছে যে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কেউ কেউ নিগৃহীতও হয়েছেন। এমনকি নারী শিক্ষকও আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু শিক্ষকেরাও এর মধ্যে রয়েছেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ছাত্র ঐক্য পরিষদের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে দাবী করেছেন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ৪৯ জন শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
এগুলো থেকে ছাত্রদের নিবৃত করতে স্থানীয় পর্যায়ের সর্বজনমান্য কোন শিক্ষক কিংবা অবিভাবক মহল পর্যন্ত এগিয়ে আসার সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। যখন শিক্ষার্থীদের হত্যা, গুলি, গ্রেপ্তার চলেছে, তখন দেশের অনেক শিক্ষক চুপ ছিলেন এমন অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই যদি মানদন্ড হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এই অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’, ‘তখন আপনাকে দেখি নাই কেন’, ‘গর্ত থেকে বের হয়েছেন’ এ রকম প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই শিক্ষকদের শুনতে হচ্ছে।
অনেক শিক্ষকের মতে, ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসাটা অনুভ‚তির ব্যাপার, সেটা লোকদেখানো কিছু নয়। মনে রাখা দরকার ফেসবুক মানে জীবন নয়। সবার সব আবেগ সবাই ফেসবুকে প্রকাশ করে না। এ রকম অসংখ্য শিক্ষক আছেন, যাঁরা ফেসবুকে লেখালেখি করতে পছন্দ করেন না কিংবা অভ্যস্ত নন।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় বিবেচনায় কিংবা অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি হয়েছে। অনেক মেধাবী শিক্ষককে পেছনে ফেলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের পদোন্নতির দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হয়েছে। এসব কারণে শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে বঞ্চনাবোধ ও ক্ষোভ জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একটি অন্যায়ের প্রতিকার তো আরেকটি অন্যায় দিয়ে হতে পারে না। আইনি পথেই এর প্রতিকার খুঁজতে হবে। এখানে গায়ের জোর দেখানোর সুযোগ নেই।
শিক্ষকেরা জাতি গঠনের কারিগর। তাঁদের ওপর এই হামলার ঘটনাগুলো লজ্জার। শিক্ষকদের প্রতি এই অপমান ও লাঞ্ছনা জাতির জন্য চরম লজ্জাজনক। শিক্ষকদের প্রতি এভাবে লাঞ্ছনা ও নিগ্রহ চলতে থাকলে জাতি হিসেবে বিশ্বে এই জাতির পরিচিতি কি হবে তা এরা ভাবছে না। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রত্যাশী এদেশের ছাত্রদের কিভাবে বিবেচনা করা হবে বোঝার সক্ষমতা এদের আছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
এ–ই ভাবে কি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থদের জন্য আগের সেই মধুর পরিবেশ ফিরিয়ে আনা যাবে? ভালোবাসার আর সম্মানের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানগুলো ফিরে যেতে পারবে? এমন অবস্থায় আসলেই কি শিক্ষার আগের পরিবেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব?
স্মরণ রাখা উচিৎ, ছাত্রদের ক্লাসে ফিরে আসতে হবে। এখনই সব স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন। কী করা যেতে পারে সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য ভাবার সময়ও এখনই।
আশার কথা, শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, লক্ষ্য করা গেছে যে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও নানাভাবে হেনস্থা করার ঘটনা ঘটছে যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্য করে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগ আছে তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের চিহ্নিত করে প্রচলিত আচরণবিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বেআইনি ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত হলে তার প্রতিকারের জন্য ইতিমধ্যেই স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থেই নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।
সমাজের প্রতিটি সটেতন মানুষেরই চাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর এবং মূঢ়তার বিরুদ্ধে যুক্তির পথে চলার সংগ্রাম অব্যহত থাকুক। একই সাথে প্রত্যাশা- অবিলম্বে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ‘চর দখলের লড়াই’ বন্ধ করা হোক।