দেশের ব্যাংক খাতের বিষফোড়া খেলাপি ঋণ। এই ফোড়া নিরাময়ে গত সাড়ে ১৫ বছরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। উলটো নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। যদিও অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা কিছুই নয়। প্রকৃত খেলাপি পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বহু আগে। যার পরিধি এখন অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যাংক খাতের প্রধান ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত খেলাপি ঋণ সবশেষ তিন মাসে টাকার অঙ্কে বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে ইতিহাসের সর্বোচ্চে গিয়ে ঠেকেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেছেন, জুন পর্যন্ত সময়ে শ্রেণিকৃত ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে। চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ দেওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। সবশেষ তিন মাসে শুধু টাকার অঙ্কেই খেলাপি ঋণ বাড়েনি; বেড়েছে শতকরা হারেও। বিগত সরকার খেলাপিদের নানা সুবিধা দিয়েও এই সূচকের লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২৪ সালের জুন শেষে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের রেকর্ড।
গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি। অর্থাৎ ৩ মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে সুশাসন ও খেলাপি ঋণই ছিল ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা। ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে দিন দিন খেলাপি বেড়েছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের তথ্য গোপনেরও একটি চেষ্টা ছিল। সব মিলিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তথ্য গোপন না করায় হঠাৎ এই সূচকে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকার পতনের আগেই আইএমএফের শর্ত মেনে গত মার্চ থেকে কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ কমে এসেছে। আবার তদারকি শিথিলতার কারণে অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আর ফেরত আসছে না। সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যবসায়ীদের অনেকেই পালিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুন শেষে দেশে মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা মার্চ শেষে ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬ মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ৬৫ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এত বিপুল ঋণ খেলাপি হওয়া প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দেয়, বাস্তবে তা আরও বেশি। খেলাপি হওয়ার পরে পুনঃতফসিল করা ঋণও খেলাপি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা দেখায় না। তার আশা, নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য বের করে ঋণখেলাপিদের শাস্তি আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেবেন। কারণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকখাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতের বর্তমান দুর্দশার মাত্রা কতটুক;, তার ন্যূনতম একটি সংখ্যা খেলাপি ঋণ। কারণ দেশে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের খাতগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ একটি। এছাড়া পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, মামলাসহ অন্য খাতগুলো যোগ করলে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। বিগত কয়েক বছর আগে নীতিমালা করে খেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদ ৯০ থেকে ১৮০ দিন করা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৮০ দিনের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি হিসেবে দেখানো যায়নি। সেপ্টেম্বর থেকে হয়তো সেই সুবিধা উঠে যাবে। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, আগের সরকারের আমলে ব্যাংকগুলো খেলাপির তথ্য গোপন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তথ্য পাঠানোর পরও পলিশ করা হতো। এভাবে খেলাপির তথ্য কম দেখানো হতো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কর্মকর্তারাও নির্দ্বিধায় খেলাপির তথ্য প্রকাশ করছেন। এতে খেলাপি কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, সুশাসন ও খেলাপি ঋণই বর্তমান ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা। ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার কারণে দিনদিন খেলাপি বাড়ছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় না দিয়ে পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশের জন্য দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি হলো, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কমানো।
২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। কিন্তু খেলাপি না কমে উলটো বেড়ে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশই খেলাপি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি হার প্রায় ৩৩ শতাংশে উঠেছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বহু আগে থেকে বলে আসছি বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করছে এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে আরও অন্তত তিন লাখ কোটি টাকা যোগ করতে হবে। তাহলে প্রকৃত খেলাপি পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গত জুন পর্যন্ত সময়ে বিতরণ করা ঋণের এক লাখ দুই হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৩২.৭৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি হয়ে পড়েছে ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৭.৯৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের তিন হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা ৪.৭৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা বা ১৩.১১ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।