রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবাহ এবং মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ সামনের দিনগুলোতে জনদুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলমান আন্দোলন সামাল দিয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেয়ার দাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় অনেক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়েছে। আর্থিক লেনদেন বিঘ্নিত হওয়ায় স্থবিরতা নেমে এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর কল-কারখানা চালু হলেও উৎপাদন হচ্ছে সীমিত। দেশের পরিস্থিতির কারণে কমেছে রেমিট্যান্সের গতি। বিপণিবিতানগুলোতেও ফেরেনি স্বাভাবিক অবস্থা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত। সব মিলিয়ে থমকে গেছে সার্বিক অর্থনীতির চাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বড় চাপে পড়তে পারে দেশের রিজার্ভ। বিগত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অতিষ্ঠ দেশের সাধারণ মানুষ। সরকারের নানা পদক্ষেপেও মূল্যস্ফীতি কমেনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি ও মাছ-মাংসের দাম ক্রমেই নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে বেড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থাও। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় টিসিবির কার্ডধারী সদস্যরাও ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পেতে বিপাকে পড়েন। কয়েক দিন ধরে রাজধানীর সঙ্গে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা সচল হতে শুরু করলেও তার আগে উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা বন্ধ থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম যে হারে বেড়ে গিয়েছিল, সেটা এখনও পুরোপুরি আগের জায়গায় ফেরেনি।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দেশের সংকটময় পরিস্থিতির কারণে সব মাধ্যমেই লেনদেন কমেছে। কিন্তু এটিএম ও পিওএসের লেনদেন স্বাভাবিক ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এনপিএসবি ও বিইএফটিএন পরিষেবা চালু ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে দাঁড়ায়। যা বিগত ২০১১-১২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অথচ অর্থবছর শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার নতুন করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক ঝুঁঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা দিতে সমস্যা হয়েছে। কারণ এখন ব্যাংকের বেশিরভাগ সেবা প্রযুক্তি; বিশেষত ইন্টারনেটনির্ভর।
এদিকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সাররা। এ খাতের পুরোটাই ইন্টারনেটনির্ভর। কয়েক দিন ইন্টারনেট না থাকায় সারা দেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশ থেকে গ্রাহক বা বায়ারের পাঠানো বার্তার উত্তর দিতে পারেননি। আবার কারও কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার সময় পার হয়ে যায়। এর একটা সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন রপ্তানিকারকরা। বিদেশি পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় বিপুল রপ্তানি আদেশ হাতছাড়া হয়েছে। তাছাড়া যোগাযোগের ঘাটতির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে হুমকি তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্য আগে থেকেই খারাপ অবস্থায় ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও এটিকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। রেমিট্যান্সেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী নেতা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে তাদের কেউ কেউ। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। যা চলতি বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এছাড়া রপ্তানি খাতেও সামনে বড় চাপ আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় রপ্তানি আদেশ পেতে সমস্যার পাশাপাশি তৈরি পোশাক শিল্পের ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েক দিন কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, হঠাৎ করে এভাবে রেমিট্যান্স কমে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। যদিও দেশ একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকসহ সবকিছুই বন্ধ ছিল, তাই হয়তো এর প্রভাবে রেমিট্যান্স কম আসতে পারে। তবে এর বাইরে অন্য কোনো কারণ আছে কি না সেটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের। তিনি বলেন, দেশে রেমিট্যান্স আসা কমে যাওয়ার বিষয়টিকে হালকাভাবে না নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ রিজার্ভের অবস্থা ভালো নয়, রপ্তানি আয়ও কম আসছে। এ অবস্থায় রেমিট্যান্সও যদি কমে যায় তা হলে রিজার্ভ সংকট দেখা দেবে। তাই আগে থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।