রাজধানীর ওয়ারী এলাকার তরুণ উদ্যোক্তা সানোয়ার হোসেন। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হবেন- এই বাসনা থেকে খোঁজখবর নেন, কোন ধরনের ব্যবসা চালু করা যায়। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবে সঙ্গে আলোচনা করেন। অনেকেই পরামর্শ দেন-সবসময় মানুষের প্রয়োজন হয় এমন কোনো পণ্যের ব্যবসা শুরু করতে। সে ক্ষেত্রে লোকাল ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরির কারখানা দেয়ার পরামর্শই বেশি আসে। নিজের গোছানো কিছু অর্থ, পরিবার থেকে পাওয়া অর্থ এবং ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরুর প্রস্ততি নেন তিনি।
এতদূর পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু যখনই তিনি ব্যবসা শুরু করতে সরকারি অফিসে যান বিভিন্ন সেবা নিতে- তখনই তিনি হোঁচট খান। ট্রেড লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন, ইনকাম ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগসহ সরকারি বিভিন্ন দফতরের যেখানেই যান সেখানেই ঘুষ চাওয়া হয়। ঘুষ ছাড়া কোনো দফতরেই সেবা মেলে না। কয়েক মাস ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যখন দেখলেন ঘুষ ছাড়া কাজ হবে না, তখন তিনি সব সেবা প্রতিষ্ঠানে মোট তিন লাখ টাকার ঘুষ দেন। কোনো জায়গায় দালাল ধরে কাজ সারেন আবার কোনো জায়গায় নিজে সরাসরি ঘুষ দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করেন। এভাবে ব্যবসার শুরুতে সরকারি দফতরগুলোতে ঘুষ দিতেই তার পকেট খালি হয়ে যায়। কেরানীগঞ্জে এখন তার কারখানাটি চালু হয়েছে বছরখানেক হলো- কিন্তু ঘুষ তাকে এখনও প্রতি মাসে দিতে হয়। হয়তো যতদিন ব্যবসা করবেন-এভাবে ঘুষ দিয়েই ব্যবসা চালাতে হবে।
শুধু একজন সানোয়ারের হোসেনের ক্ষেত্রে নয়, রাজধানী ঢাকা শহর, আশপাশের জেলা শহর, বিভাগীয় পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়েও ব্যবসা করতে চান বা করবেন- এমন যেকোনো উদ্যোক্তাকে ঘুষ দিতেই হবে। তাই ব্যবসার শুরুতে সরকারি দফতরগুলোতে ঘুষ দেয়া বাবদ বিনিয়োগের অর্থের একটি অংশ আলাদা করে রেখেই দেন তারা।
এ রকম তথ্য জানিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে ঘুষ একটি শীর্ষ ও প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এই দুর্নীতির কারণেই ব্যয় বাড়ে, ব্যবসার সক্ষমতা কমে, ব্যবসায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সময় বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে একমাত্র ঘুষের কারণেই অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোগ শুরুতেই শেষ হয়ে যায়।’
ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকারি কোন কোন দফতরে বেশি ঘুষ দিতে হয় তারও একটি তালিকা তুলে ধরেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার শুরু থেকেই ধাপে ধাপে ঘুষ দিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন, ট্রাক্স প্রদান, ইউটিলিটি সেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি), আমদানি-রফতানি, বন্দরের সেবা, সরকারি টেন্ডার এবং সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বেশি ঘুষ দেয়া লাগে। এভাবে ঘুষ দিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো ভিন্নভাবে পুষিয়ে নিতে পারে, কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এই ঘুষের ধকল সামলাতে পারেন না।
ব্যবসায়ীরা ধরেই নেন-ব্যবসা করতে হলে ঘুষ দিতে হবে। এ জন্য ব্যবসায়ীরা ঘুষ বাবদ আলাদা বরাদ্দই রাখেন। সবচেয়ে বড় কথা এই ঘুষের কারণেই ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা সে খরচ পুষিয়ে নিতে পণ্য বা সেবার দাম বাড়িয়ে দেন, এমনকি এই ঘুষের কারণে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তাদের মজুরিও কম নির্ধারণ করেন। সম্প্রতি সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এবং সিপিডি ব্যবসায় দুর্নীতি ও ঘুষের বিষয়ে পৃথক দুটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতির সবচেয়ে বড় জায়গাগুলো হচ্ছে- লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত অফিস (২৮ দশমিক ৮ শতাংশ), ট্যাক্স অফিস (২১ দশমিক ৬ শতাংশ), স্থানীয় সরকার বা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা (১৯ দশমিক ৫ শতাংশ), ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস (১৩ দশমিক ৫ শতাংশ), পরিবেশ অধিদফতর (১২ দশমিক ৩ শতাংশ) এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (১০ দশমিক ৬ শতাংশ)।
জরিপের আরেক অংশে বলা হয়েছে- একাধিক সেবাগ্রহীতার অভিযোগ, ই-টিন (টিআইএন) নিবন্ধন, আয়কর রিটার্ন প্রতিবেদন, টিন (টিআইএন) সনদ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ দাবি করেন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘুষ না দেয়া পর্যন্ত কোনো কাজই হয় না। এ ছাড়া কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার ভয় দেখিয়েও ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এতে বলা হয়, দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা, সেটি সব ধরনের ব্যবসায়ী বলেছেন। যেসব খাত এসেছে; তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন কর দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ৫৪ শতাংশ বলছেন লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে; গ্যাস, বিদ্যুৎ নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৪৯ শতাংশ এবং আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী।
জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়, ৫২ শতাংশ এসএমই প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ দিতে হয়। ৭১ শতাংশ এসএমই প্রতিষ্ঠান মনে করে যে দুর্নীতির কারণে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। ৬১ শতাংশ এসএমই প্রতিষ্ঠান ঘুষ দিয়ে সরকারি নিয়মকানুন এড়িয়ে যায়। এ ছাড়া নতুন লাইসেন্স সংগ্রহ এবং নবায়নের ক্ষেত্রে ঘুষ দেয়া-নেয়া বেশি হয়। এর আগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ এবং বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ (সিআইপিই) ব্যবসায় ঘুষ বিষয়ে আরেকটি যৌথ জরিপ চালায়। বাংলাদেশের এসএমই খাতের সঙ্গে জড়িত ৮০০ জন জাতীয় প্রতিনিধি নিয়ে এ খাতের সার্বিক অবস্থার ওপর এ জরিপ করা হয়। এ গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে নতুন লাইসেন্স তৈরি এবং নবায়ন, সরকারি সেবা ব্যবহার, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিন) সংগ্রহ, ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) সনদপত্র সংগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের ঘুষ দিতে হয়।
জরিপে দেখা যায়, তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন মনে করেন যে দুর্নীতি একটি সংক্রামক ব্যাধি। ব্যবসায়ীদের ৬২ শতাংশ বিশ্বাস করেন প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই দুর্নীতির শেকড় অন্তর্নিহিত। আরও অধিক সংখ্যক বা ৭১ শতাংশ মনে করেন যে, দুর্নীতির অত্যধিক উপস্থিতি বাজারকে আরও অসম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে।
অর্ধেকেরও বেশি উত্তরদাতা মনে করেন, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে কঠোর সরকারি নিয়মকানুন দুর্নীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এসব ধারণার কারণে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬১ শতাংশ উদ্যোক্তা ঘুষ দেওয়ার মতো অনৈতিক পথ বেছে নিয়েছেন।
জরিপে নতুন লাইসেন্স তৈরিতে ৩৬ শতাংশ এবং নবায়নের ক্ষেত্রে ৩১ শতাংশ দুর্নীতির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ লোক যারা ঘুষ প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যে ধারণা বিদ্যমান যে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুষ প্রদান করা প্রয়োজন এবং ঘুষ প্রদান সময় বাঁচায়।
এদিকে, ঘুষ দেয়ার ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদেরও চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের আরও বেশি ঘুষ সংক্রান্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ঠিক এমনটিই জানালেন, রাজধানীর মিরপুর মধ্যপাইকপড়া এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শাহেদা খানম। তিনি বলেন, শুধু উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে তাকে অতিরিক্ত হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। এ জন্য প্রথমে শোরুম দিলেও এখন তিনি শুধু অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন। এই ঘুষের কারণে বর্তমানে নতুন নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর অন্যতম কারণ হলো- এ ক্ষেত্রে তাদের ট্রেড লাইসেন্সের দরকার হয় না বা দুর্নীতির শিকার হতে হয় কম। এতে কিন্তু আমার ব্যবসা খুব যে ভালো চলছে তা কিন্তু নয়। আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকার কয়েকটি এলাকায় আমার বেশ কয়েকটি নিজস্ব শোরুম থাকবে, ধীরে ধীরে বড় উদ্যোক্তা হব। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতির কারণে আমার আর সেটা হওয়া হলো না। এখন আমি কোনো রকম টিকিয়ে রেখেছি ব্যবসাটি।
সম্প্রতি রাজধানীতে মেট্রোপলিটন চেম্বারের এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায় ঘুষের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। ব্যবসায় ঘুষের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ-দুর্নীতিতে ভরে গেছে। একজন নতুন উদ্যোক্তা হোক কিংবা পুরোনো উদ্যোক্তা- ঘুষ দেওয়া ছাড়া কেউই ব্যবসা করতে পারবেন না। বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতি একটি অপ্রিয় চরম সত্যে পরিণত হয়েছে, যা সমাজ থেকে সহজে নির্মূল করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির কারণে সমাজের প্রশাসনিক এবং সরকারি গোষ্ঠী লাভবান হলেও উদ্যোক্তারা বর্তমানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্যোক্তাদের নতুন ব্যবসা শুরু থেকে তা পরে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া এবং ঘুষ দেওয়া একটি স্বাভাবিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছে না।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার যতদিন চাইবে না, সরকারি দফতর থেকে ঘুষ-দুর্নীত বন্ধ হোক-ততদিন এটি বন্ধ হবে না। দেশে যেসব আইন, বিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেসব বিধিমালা রয়েছে তা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত। সরকার চাইলেই এটি বন্ধ করা সম্ভব।