বর্তমানে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বাজারে যাচ্ছেন, কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর মিলছে না চাকরি অথচ তারা উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু কেন উচ্চশিক্ষিত হয়েও বেকার থাকতে হয়; তা প্রশ্ন থেকেই যায়! দেশে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ তরুণ। কর্মসংস্থান না থাকায় এদের দুই-পঞ্চমাংশের বেশি অলস সময় পার করছেন। প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা না থাকায় তরুণদের বড় অংশ কাজে যোগ দিতে পারছে না। সরকারও এদের জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারছে না। সরকারি চাকরিতে মানুষের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখনো ৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি পদ শূন্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।
বেসরকারি এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মূল টার্গেট একাডেমিক সনদ পাওয়া কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফল করা। কিন্তু বাস্তবমুখী পড়াশোনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। এ কারণে উচ্চশিক্ষিত হয়েও থাকতে হচ্ছে বেকার, মিলছে না চাকরি। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের বাস্তবমুখী শিক্ষা দরকার।
একসময় একটা কাজ করার জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো, কিন্তু বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। যেকোনো কাজ কম লোকসংখ্যা এবং স্বল্প সময়ে করা যাচ্ছে; এ কারণে অনেক মানুষ কর্মহীন থেকে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, প্রতিবছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি এবং অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না করলে এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। শিক্ষাকে যদি কর্মমুখী করে তোলা যায়, তবে শিক্ষিত মানুষের চাকরি পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। নতুন নতুন শিল্প কারখানা হচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থারও পরিবর্তন প্রয়োজন। কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। আবার শিক্ষার্থীদেরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার অভাব এবং অনভিজ্ঞতাই তরুণদের বেকারত্বের মূল কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী হওয়া দরকার। লেখাপড়া শুধু পরীক্ষা আর ডিগ্রিকেন্দ্রিক হলে হবে না। লেখাপড়া হতে হবে জ্ঞানকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। শুধু কেতাবি শিক্ষা কাজে লাগছে না। এদিকে’ গত মে মাসে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে নতুন করে বেকার হয়েছেন ২ লাখ ৪০ হাজার জন। এই তিন মাসে নারী ও পুরুষ উভয় জনসংখ্যার মধ্যেই বেকারত্ব বেড়েছে। তবে গত বছরের একই প্রান্তিকের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, সার্বিক বেকারত্ব হার একই রয়েছে। কিন্তু পুরুষের বেকারত্ব বেড়েছে এবং নারীদের ক্ষেত্রে তা কমেছে। তবে ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেড়েছে ৩.৫১ শতাংশ। দেশে এখন কর্মহীন লোকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন; যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ করে তুলতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে শ্রমশক্তি তার কতটুকু আমরা কাজে লাগাতে পারছি, সেটাই মূল বিষয়। প্রত্যেক বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় দশ লাখের বেশি জনশক্তি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রায় ৫ লাখ যুক্ত হচ্ছে। কর্মের সুযোগ দেওয়া যাচ্ছে না বলে প্রত্যেক বছর প্রায় ৫-৬ লাখ কর্মহীন অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। আবার যারা কর্মে যাচ্ছে সে খাতে সমস্যা রয়েছে। আমাদের টেকনিক্যাল ও ভোকেশনালের দিকে ফোকাস নেই। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। দেশের বাজারে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। কারণ সেভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে না। যেগুলো হচ্ছে তা অটোমলাইজেশন। সেখানে প্রয়োজন দক্ষ লোকের। কিন্তু সেই লোক আমাদের নেই। জোগান দেওয়ার মতো জনশক্তি আমরা তৈরি করতে পারছি না। সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, প্রশাসক হতে চায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স জরিপে উঠে এসেছে, দেশের মোট যুব জনশক্তির দুই-পঞ্চমাংশের বেশি (৪০.৬৭ শতাংশ) কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের (এনইইটি) কর্মসূচিতে নেই।
মেয়েদের মধ্যে এ হার ৬১.৭১ শতাংশ। যা পুরুষের তুলনায় ১৮.৫৯ শতাংশ বেশি। দেশের সব বিভাগ এবং পল্লী ও শহরাঞ্চলে নিট জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রায় একই রকম। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে সর্বাধিক নিট ৪৩.৯৮ শতাংশ যুব জনশক্তির উপস্থিতি মিলেছে। আর বরিশাল বিভাগে মিলেছে সর্বনিন্ম ৩৮.৩২ শতাংশ। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাদের ১৩-১৪ লাখের দেশে কর্মসংস্থান হয়। বাকিরা দেশের বাইরে যান। গত দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা ২৪ থেকে ২৮ লাখের মধ্যে রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ বেকার।
এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বেকারত্ব কমাতে হলে বেসরকারি খাতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়লেই নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, গত এক দশক ধরে জিডিপি ২২-২৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বেসরকারি খাতে কীভাবে বিনিয়োগ বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোর উন্নতি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দমন করতে পারলে বেকারত্ব কমে আসবে। এর বাইরেও দক্ষ করে বড় একটি অংশ যদি দেশের বাইরে পাঠানো যায়; তাহলেও বেকারত্ব কমতে পারে।