প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছিল রেমিট্যান্স প্রবাহ। বলা যায়, গত জুনে বাজিমাত ঘটিয়ে দিয়েছিলেন প্রবাসীরা, এ মাসটিতে রেমিট্যান্স বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ পরিমাণ আহরণ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুাযায়ী, গত মাসে (জুন ২০২৪) মাসে রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা) প্রায় ২৯ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থ্যাৎ সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে রেকর্ড আড়াই ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। রেমিট্যান্সের এই প্রবাহে সঙ্কটে থাকা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা অনেকটাই থমকে গেছে। ইন্টারনেট বন্ধ ও দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষ ও কারফিউর প্রেক্ষাপটে চলতি জুলাইয়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহে পতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৯৮ কোটি ডলার এসেছিল প্রথম ১৩ দিনে। আর ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ১০ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৫৩ কোটি ডলার। যেখানে গত মাসে (জুন) প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। জুনের পর জুলাইয়ের তথ্যে সংশ্লিষ্ট সেক্টরে মন্দাভাব দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ১৯ থেকে ২৪ জুলাই ছয় দিনে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রবাসী আয় এসেছে সাত কোটি ৯০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ছয় দিনে আসা রেমিট্যান্স একদিনের চেয়েও কম। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতার জের এখনও কাটেনি। একের পর এক নিহত হওয়ার খবর, সরকারি স্থাপনায় ব্যাপক ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ, তারপর সারাদেশে কারফিউ জারি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় আরও তিনদিন। ফলে টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিলো অফিস-আদালত ও ব্যাংক। এসবের ফলে দেশের অভ্যন্তরে কার্যত বন্ধ ছিলো অর্থনৈতিক কার্যক্রম। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ব্যাংকের এটিএম বুথ কিংবা অনলাইন লেনদেনও করতে পারেননি গ্রাহকরা। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের মোবাইল ব্যাংকিং। এমন পরিস্থিতিতে ভাটা পড়ে প্রবাস থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সে। সহিংসতার সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে রেমিট্যান্স আসা।
অথচ রেমিট্যান্স আসার চিত্রটা দারুণ ছিলো গত দুই মাস ধরে। গত জুনে ২৫৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসে থাকা প্রায় দেড় কোটি বাঙালি, যা এক মাসের হিসাবে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, তার আগের মাস মে-তে মোট প্রবাসী আয় আসে ২২৫ কোটি ডলার, যা সেই সময়ের হিসাবে চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিলো। সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের মে মাসের তুলনায় জুনে অবস্থা ছিল আরও ভালো। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে এসেছে ২৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৩৯১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২৩১ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখা খুবই জরুরি।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান উৎস রফতানি খাত হলেও রেমিট্যান্সের ভ‚মিকাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশের রফতানি আয় ছিল ৩ হাজার ৭৩৪ কোটি বা ৩৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে প্রবাসীরা ২১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের বিপরীতে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় মাত্র ৬-৭ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু রেমিট্যান্স হিসেবে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠান তার বিপরীতে দেশের কোনো ব্যয় নেই। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পুরোটাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভ‚মিকা রাখছে। সেকারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে কোনো প্রতিবন্ধকতাই কাম্য নয়। আমাদের উচিৎ যেকোনো মূল্যে যত দ্রæত সম্ভব রেমিট্যান্সে প্রবাহ বাড়িয়ে তোলা।
এমিতেই দেশে হুন্ডির বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য কখনোই সুখকর নয়। অব্যাহত ডলার সংকট ও বিনিময় হারের সমন্বয়হীনতার কারণে দিন যত যাচ্ছে হুন্ডির বাজার তত বড় হচ্ছে। ফলে অনেক প্রবাসী বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক সংকট আরও ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও উচ্চতায় পৌঁছাবে। এ কারণে হুন্ডির পথ বন্ধে কঠোর হওয়ার পাশপাশি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পেতে সরকারকে আরও কৌশলী ভ‚মিকা পালন করতে হবে।
লেখক: মেহেরুন নিছা মেহেরীন, সাংবাদিক ও কলামিস্ট