বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নেয়ার রেকর্ড গড়েছে সরকার। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে তিনগুণের বেশি ঋণ নিয়েছে। গত আড়াই বছরে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে টাকার তারল্য কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়ার সক্ষমতা কমে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় ও ব্যয় বাড়ায় নিতে হয়েছে বাড়তি ঋণ। ফলে বাধ্য হয়েই সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিতে হয়েছে। আবার ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখন তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর সরকার যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিচ্ছে; তার বেশির ভাগই সুদ-আসলসহ ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হচ্ছে। এতে একদিকে টাকার প্রবাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তাই ব্যাংক থেকে ধার করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। শুধু চলতি জুনেই ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চাইছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সরকার বাজার থেকে বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু নিলামে লক্ষ্য অনুযায়ী টাকা উত্তোলন সম্ভব হয়নি। ১১ দশমিক ৬৫ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দিয়েও প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বিল বিক্রি সম্ভব হয়েছে। ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে এত পরিমাণ ঋণের জোগান আসাটাও বড় ঘটনা। ব্যাংক নির্বাহীরা অবশ্য বলছেন, চলতি মাসে সরকারকে এত পরিমাণ ঋণ দেয়ার সক্ষমতা ব্যাংক খাতের নেই। এ অবস্থায় সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে গত অর্থবছরের মতো নতুন টাকা ছাপাতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এসব টাকা উৎপাদনমুখী কাজে ব্যয় করা হলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা কিছুটা উপশম করতে পারে। কিন্তু যদি দৈনন্দিন কাজে ব্যয় হয় তবে তা আরও বেশি বিপজ্জনক। সরকার এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ চলতি ব্যয় নির্বাহে ব্যবহার করছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে ৯২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। আর গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এ খাতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। সুদের হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সুদ পরিশোধ বাবদ চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যয় আরোও বাড়বে। সেক্ষেত্রে তা ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এ জন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ মানেই হচ্ছে ছাপানো টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরজুড়েই টাকা ছাপানোর কাজটি করে। ছাপানো টাকা ভল্টে রাখা হয়। ভল্টে থাকা অবস্থায় একে বলে জড়বস্তু বা নন লাইভ টাকা। বাজারে চাহিদা বাড়লে টাকা ছাড়ে। ছাপানো টাকা বাজারে এলেই একে বলা হয় লাইভ বা জীবন্ত। অর্থাৎ ভল্টে থাকলে মূল্যহীন কাগজ ও বাজারে এলে মূল্যমান মুদ্রা। বিশ্লেষকরা বলছেন, গত আড়াই বছরে দেশে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর প্রভাবেও টাকার অঙ্কে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। অবশ্য টাকার অঙ্কের পাশাপাশি ডলারের হিসাবেও বেড়েছে বিদেশি ঋণের পরিমাণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যানুসারে, গত ২০২৩ সালের জুন শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৬০ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের জুন শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৪১ কোটি ডলারে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার যে ঋণ পরিশোধ করেছে তার মধ্যে আসল ঋণ ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বাকি ১১ হাজার ৬০১ কোটি কোটি ৮৩ লাখ টাকা সুদ বাবদ দিতে হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১৬ হাজার ৯৬৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে আসল ছিল ১২ হাজার ২০২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের যেখানে চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা সুদ দিতে হয়েছিল; সেখানে গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ। এ সময়ে ডলারের হিসাবে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার; যা আগের বছরে ছিল ১৭৩ কোটি তিন লাখ ডলার।
এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব ও সরকারের সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, মূল বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আহরণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে মূল বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেটে সরকারের ব্যয় কমলেও সেটির ব্যবধান খুব বেশি নয়। ফলে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধির তুলনায় সরকারের ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়ে থাকে। এ কারণে স্থানীয় উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে বাজেট সহায়তার ঋণ, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট এবং চীন ও রাশিয়ার ঋণের কারণে সরকারের বিদেশী ঋণও বেড়েছে।
এতে সরকার নিজেই ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। এবার সেটি করতে না পারায় ট্রেজারি বিলের সুদহার এতটা উচ্চতায় উঠে গেছে। দেশের ব্যাংক খাতে সরকারই এখন সবচেয়ে বড় ভোক্তা। সরকার উচ্চ সুদে ঋণ নেয়া অব্যাহত রাখলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। উচ্চ সুদের এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের অর্থ সংকট আরো তীব্র হবে। তখন আরো বেশি সুদে ঋণ নিয়ে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঋণের দুষ্টচক্রে যেভাবে জড়িয়ে পড়ছে; সেখান থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন। রাজস্ব ঘাটতি সত্ত্বেও সরকার প্রতি বছর বিরাট আকারের বাজেট ঘোষণা করছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে টাকা নেই। এ কারণে উচ্চ সুদে সরকার ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন সরকারই সবচেয়ে বড় ভোক্তা। ব্যাংক নির্বাহীরা সরকারকে ঋণ দিয়ে ?নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারছেন। ব্যক্তি খাতে ঋণ দেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাই ব্যাংকের এখন নেই। কেবল পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ব্যবসা দেখলেই হলো। আবার গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। সে ঋণ দেশের মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে সহায়তা করেছে।