প্রকাশ: রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৬:৪৭ পিএম (ভিজিটর : ৭১৫)
বাসা-বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে শিশুরাই বেশি শ্রম দিচ্ছেন। তাছাড়া খাবারের হোটেল, টি-স্টল, বিভিন্ন মেকানিকাল দোকান, কল-কারখানায় কাজ করছেন শিশুরা। যে বয়সে তাদের বিদ্যালয়ে থাকার কথা সে বয়সে তারা কায়িক পরিশ্রম করছে। অথচ বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে শিশুদের নিয়োগ বেআইনি। কিন্তু এই কাজেই বাংলাদেশের ১০ লাখের বেশি শিশু নিয়োজিত। গত ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখা বেড়েছে প্রায় এক লাখ। এই শিশুশ্রম কমাতে সরকারের আছে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। আর গত ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখা বেড়েছে প্রায় এক লাখ।
সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শিশুশ্রম মুক্ত করার কথা বলছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএন) প্রকাশিত জরিপে দেখা যায় দেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। তাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। শ্রমজীবী শিশুদের ১০ লাখ ৬৮ হাজারই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত। ঝুঁকি নেই এমন কাজে যুক্ত আছে সাত লাখ সাত হাজার শিশু। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে বিবিএস যে জরিপ করে তাতে দেশে তখন মোট শিশু শ্রমিক ছিলো ১৬ লাখ ৯৮ হাজার। এই সময়ে শিশু শ্রমিক না কমে উল্টো ৭৭ হাজার বেড়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সংখ্যা সামান্য কমেছে। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সংখ্যা ছিলো ১২ লাখ ৮০ হাজার। গত ১০ বছরে তা দুই লাখ ১২ হাজার কমেছে।
বিবিএসের জরিপে পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাঁচ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের ধরলে দেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার। দেশে এখন পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা তিন কোটি ৯৯ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞায় পাঁচ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত শিশু ধরা হয়। এরমধ্যে পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা, ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সি শিশু সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা এবং ১৪ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করালে তাকে শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়।
সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম পুরোপুরি দূর করতে দুই হজার ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু তাতে শিশুশ্রমিক না কমে উল্টো বাড়ছে। আর বাংলাদেশের শ্রম আইনে ১৪ বছর বয়সের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবেনা। কিন্তু দেশে মোট শিশুশ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি ওই বয়সের। ২০২২ সালে বাংলাদেশ আইএলও সনদ অনুমোদন করে। আর তখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলা হয় ১৪ বছর পর্যন্ত কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবেনা। আর কোনো শিশুকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়েগি করা যাবেনা। কিন্তু বাংলাদেশে শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, যারা ৫-১৪ বছর বয়সী শিশু যাদের বেতন বা অবৈতনিক উভয় ক্ষেত্রে এক বা একাধিক ঘণ্টা (প্রতি সপ্তাহে) কাজ করে তাদের শিশু শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ) শিশুশ্রমকে এমন কোনো কার্যকলাপকে সংজ্ঞায়িত করে যা শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। যদি শিশুশ্রমটা আটকানো না যায় তাহলে স্বপ্ন দেখা শিশুর স্বপ্নগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধা প্রাপ্তি-সংক্রান্ত বিশেষ আইন রয়েছে; যা শ্রম আইন ২০০৬ নামে পরিচিত। এতে বলা রয়েছে কাজে যোগদানের কমপক্ষে বয়স ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে ১৮ বছর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ১৪ বছর হওয়ার আগেই শিশুদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে; তাছাড়া একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ সেসব কাজে কোমলমতি শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে, যা মোটেও উচিত নয়। এর একটি প্রধান কারণ হলো, শিশু শ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। তাই নিয়োগকারীরা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগায় এবং কাজ বেশি করিয়ে নেয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে, এতে বলা রয়েছে কেউ যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেয় তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে শিশুশ্রম মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে প্রধান বাধা। তাই শিশুশ্রম রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই লক্ষ্যে ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে শ্রম সংস্থাটি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছর বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করে আসছে। বাংলাদেশে ও দিবসটি পালন করে আসছে, কিন্তু এটি এমন একটি সমস্যা যা নিয়ম করে সমাধান করা সম্ভব না, প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিটি শিশুর সুস্থ ও নিরাপদভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যেতে হবে। শিশুশ্রমের মৌলিক কারণগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। শিশুদের সুস্থ ও উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য যুগোপযোগী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিশুশ্রম অধিকার সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে; এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুশ্রম দমনে কঠোর আইন বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি সুস্থ সুন্দর রাষ্ট্র এবং আদর্শ জাতি গঠনে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবেই আজকের শিশুরা আগামীতে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: হাসান আল বান্না, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক