আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মাত্র কয়েকটি রাষ্ট্র যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের দেশকে স্বাধীন করেছে। বাংলাদেশ সেদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে। কারণ, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে বাঙালি জাতির। যদিও বিশ্বের মানচিত্রে খুব ক্ষুদ্র একটা দেশ এটা, দেশটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বলা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ কিন্তু আমাদের সংগ্রামের নাম মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তি কথাটা এখানে ফোরগ্রাউন্ডেড। এ মুক্তি আসলে কিসের মুক্তি, সেটার পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এ মুক্তি সব পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মুক্তি, স্বাধীন ভাবে নিজের মাটি, বায়ু প্রকৃতির স্বাদ আস্বাদনের মুক্তি, এ মুক্তি সব শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি। এ মুক্তির স্বাদ বাঙালি আস্বাদন করতে চেয়েছে অনেক আগেই। তাদের মননে, মগজে, অন্তরে ছিল পরাধীনতা থেকে মুক্তি, শিকল থেকে মুক্তি, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক,দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন থেকে মুক্তি। যে মুক্তির জন্য এত সংগ্রাম, এত ত্যাগ, এত অপেক্ষা, সেই মুক্তি আসলে কতটা মিলেছে আমাদের? এমন প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে। কিন্ত স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও দেশের রাজনীতিকরা তরুণদের মনস্তাত্ত্বিক এই ঐকমত্যের সমাধানে আসতে পারেননি, এটাই আমাদের প্রজন্মের দুর্ভাগ্যের কারণ। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেখা গেছে, নানামাত্রিক ব্যাখ্যা ও পরিবেশনার ভিড়ে তরুণ প্রজন্ম বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটুকু ধারণ ও লালন করতে পারছে, সেটা আশঙ্কার বিষয়। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বয়সও ৫২ বছর পেরিয়েছে। এতগুলো বছরেও ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
অথচ রাজতন্ত্র থেকে সবে গণতন্ত্রে পা দেওয়া নেপাল এবং কয়েক লাখ মানুষের দ্বীপদেশ মালদ্বীপও একটা গ্রহণযোগ্য ও স্বস্তিদায়ক নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।
সদ্য শেষ হওয়া মালদ্বীপের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ পরাজিত হন মালের মেয়র মোহামেদ মুইজ্জুর কাছে। সলিহ পরাজয় স্বীকার করে মুইজ্জুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানান। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের এটাই তো স্বাভাবিক চর্চা। আমাদের রাজ নৈতিক দলগুলো দিল্লি বা ওয়াশিংটনের দিকে মুখ চেয়ে না থেকে কিংবা আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কবে গণতন্ত্রের চর্চা করতে শিখবে?এটাই তরুণ প্রজন্মের জিজ্ঞাসা?তরুণদের যদি প্রান্তিক করেই দেওয়া হয়, তাহলে রাজনীতিবিদেরা কাদের জন্য রাজনীতি করেন? ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলেছেন ছাত্র-তরুণেরাই। বলা চলে, এ ভূমির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গোড়াপত্তন। এরপর ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সব কটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখিয়েছেন তরুণেরা। এমনকি ২০০৮ সালের আগস্টে জরুরি অবস্থা অবসানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ছাত্র-তরুণেরা।অথচ দেড় দশকের মধ্যে রাজনীতিতে তরুণেরা এতটাই প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন যে ভোট দিতে চাই দাবি জানিয়ে তাঁদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত কাছে আসছে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা তত বাড়ছে। এর মধ্যেই ভোট দিতে চাই তরুণদের এই দাবি জোরালো হচ্ছে। এই দাবিতে দেশের ছাত্র ও তরুণদের সংগঠনগুলো নিয়মিত কর্মসূচি পালনও করছে। কখনো সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে, কখনো মিছিলে গলা মিলিয়ে, আবার কখনো প্ল্যাকার্ড তুলে ভোট দিতে চাই দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। দেশে এখন তরুণ ভোটারের সংখ্যা আড়াই কোটির বেশি। তাঁদের বেশির ভাগেরই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি।
অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একেবারে গোড়ার আলাপ হলো, নির্দিষ্ট সময় পরপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার অধিকার পাবেন। প্রথম ভোট ঘিরে তরুণদের আবেগ যেমন থাকে তুঙ্গে, আবার ভোটের ফলাফল নির্ধারণে তাঁদের ভূমিকাও থাকে গুরুত্বপূর্ণ।স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তরুণ ভোটারদের মন জয় করে নেওয়ার নানা উপায় খুঁজতে হয় রাজনৈতি- ক দলগুলোকে। দেশে কে কোন দলের সমর্থক হবে, সেটা অনেকটা নির্ধারিত হয় পারিবারিক সূত্রে। কিন্তু তরুণদের বড় একটা অংশ আবার পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে ভিন্ন দল কিংবা নতুন রাজনীতি বেছে নিতে পিছপা হন না।তাঁরা অনেকটাই স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক মত বেছে নেন। তরুণদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাতাবরণ নিশ্চিত করেই একটা জোরালো ভূমিকা পালন করে। সে কারণেই কখনো বামপন্থী জোয়ারে, আবার কখনো জাতীয়তাবাদী জোয়ারে, কখনো ধর্মীয় ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে গত কয়েক প্রজন্মের তরুণেরা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু তরুণদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শাসনের প্রতি অনাস্থাটা প্রবলভাবে কাজ করে। সে কারণেই সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশে নির্বাচন হলে তরুণদের ভোট জয়-পরাজয় নির্ধারণে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে জনমিতির হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ইতিহাসে তরুণেরা সবচেয়ে বেশি অসংগঠিত, স্বপ্নহীন ও রাজনৈতিক ভাবে অক্রিয়। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল কিংবা অন্যান্য ছাত্রসংগঠনে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী যুক্ত থাকলেও প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণেরা রাজনীতিতে আগ্রহী নন। দেশে তরুণদের নিয়ে খুব একটা জরিপ হয় না। ২০১৯ সালে তরুণেরা কী ভাবছেন-পত্রিকার শিরোনামে দেখা গেছে, প্রায় ৫৭ শতাংশ তরুণ রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী।
রাজনীতি জাগতিক সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু সেই রাজনীতিই যখন একটা স্বজনতোষী গোষ্ঠী তৈরি করে এবং দলের ভেতরেও গণতন্ত্রচর্চার বদলে অভিজাত একটি গোষ্ঠী সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে,তখন নিশ্চিত ভাবেই তরুণদের রাজনীতিতে আগ্রহী হওয়ার কিছু থাকে না।আর বর্তমান ছাত্ররাজনীতির অবস্থাটাও তা-ই। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই দল তাদের ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। সবাই নেতা হতে চাওয়ার প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত দুই- একজনের ভাগ্যের বদল হয়। বাদবাকি অনুসারীদের জীবন হয় বরবাদ। না তাঁরা পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি পান, না রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। ফলে এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে চাঁদাবাজি, একে-ওকে পেটানো, বছরের পর বছর ধরে আদু ভাই হয়ে হলে থেকে ফাউ খাওয়া, বড় ভাইদের পক্ষ হয়ে মাস্তানি করতে গিয়ে মার খেয়ে পথ হারানোর মতো ঘটনায় তাঁরা জড়িয়ে পড়েন।এর চেয়ে বড় মানবিক অপচয় কি আর হতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না,অতীতের তরুণদের গৌরবজনক ইতিহাস আর আজকের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তফাৎ কোথায়,তা খোঁজে বের করতে হবে। এখানে উদ্দেশ্য তরুণ প্রজন্মকে দোষারোপ করা নয়, আসলে তরুণরাই দেশের সম্পদ, সব থেকে বেশি দক্ষ ওরাই। এই দেশ সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখবে তরুণদের চোখ দিয়েই। দেশের যে কোনো দুর্দিনে, প্রয়োজনে এই শ্রেণিই সবার আগে ছুটে আসবে, যার প্রমাণ আমরা ইতিহাস ঘাঁটলেই পাই। ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১-এর সব আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্র, তরুণ নেতারাই নেতৃত্বে ছিল। আমার জোর দেওয়ার জায়গা ইতিহাস বিকৃতি রোধ এবং ইতিহাসের সঠিক বোধ ও চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা প্রেরণার ইতিহাসকে নিছক রূপকথার গল্প হওয়া থেকে রোধ, সত্য ইতিহাস সংরক্ষণ ও উপস্থাপনে কাজ করা। ইতিহাস হারিয়ে গেলে একটা প্রজন্মকে দোষারোপ করে কী হবে, ব্যর্থতার দায় আমাদেরই নিতে হবে। কারণ, আমরাই হয়তো তাদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারছি না।
বর্তমান এ সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যার মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে, আমরা তা কেউ জানি না। রাজনৈতিক এই সহিংসতার চিত্র আমাদেরকে ঠিক আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোয় নিয়ে যায়। গ্রিসের অভিজাত সম্প্রদায়ের বিনোদনের জন্য গ্ল্যাডিয়েটর খেলার আয়োজন করা হতো। দুজন গ্ল্যাডিয়েটর মরণপণ লড়াই করে চলেছেন একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য। আর গ্যালারি থেকে অভিজাতেরা টান টান উত্তেজনায় সেই লড়াই দেখে চলেছেন। কেউ ক্ষমতায় থাকার জন্য, কেউ ক্ষমতায় আসার জন্য জনতাকে গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবেই ব্যবহার করছে। রাজনীতির অভিজাতেরা অনেক দূরে নিরাপদ ঠান্ডা ঘরে বসে কেউ শোর তুলছেন খেলা হবে, আবার কেউ দিচ্ছেন ভিডিও বার্তা। এমনিতেই আমাদের দেশ অনেক সমস্যায় জর্জরিত; মানুষের অভিযোগ, অনুযোগের শেষ নেই। আজ থেকে ৫০ বছর আগে জন্ম নেওয়া নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রটি কিন্তু বিচক্ষণ নেতৃত্ব পেয়ে ভগ্ন অবস্থা থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই, পরবর্তী সময়ে অপশক্তির রোষানলে পড়ে দেশে ক্রান্তিকাল চলছিল কিছুদিন, এখন কিন্তু আবার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হচ্ছে। দেশে এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড চলে, বহু বছর পর এ সময় আসে একটা দেশে। আমাদের দেশে ২০৫০ সাল পর্যন্ত তরুণদের পরিমাণ সর্বাধিক থাকবে আর বিপুল সংখ্যক এ যুব সমাজকে যদি ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়, তাদের মেধা-মনন কাজে লাগানো যায়, দেশের বাহ্যিক সৌন্দর্য বদলে যেতে খুব বেশি দেরি লাগবে না। এজন্য সবাইকে কাজ করা উচিত, যুবশক্তি যেন অপচয় না হয়, হতাশায় নিমজ্জিত হলে দেশও হতাশায় নিমগ্ন হয়ে যাবে। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে অনেকেই নানামাত্রিক হতাশা ও দেশের প্রতি বিভিন্ন অভিযোগ, অনুযোগ থেকে বিদেশে পাড়ি জমানোকেই প্রাধান্য দিচ্ছে আজকাল। যা খেয়ে মানুষ দিনাতিপাত করে সেই খাদ্যে ভেজাল থেকে শুরু করে বেকারত্ব, দুর্নীতিসহ নানাবিধ সমস্যায় আজ দেশ আক্রান্ত। মুক্তিযোদ্ধারা এসব সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নুয়ে পড়া দেশের জন্ম দিতে এত ত্যাগ করেননি, তাদের অকুতোভয় সাহস ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবাইকে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে মনোনিবেশ করা উচিত।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক